
রোকসানা মনোয়ার : রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকায়
শনিরআখড়া জিয়া সরণি সড়কে আবেদিন মার্কেটের কোনা থেকে জাপানি বাজার পর্যন্ত সড়ক ও
ফুটপাত দখল করে চার শতাধিক শতাধিক দোকান রয়েছে দু’পাশে। বর্নমালা স্কুল রোডে গোয়াল বাড়ী মোড় পর্যন্ত সড়ক
ও ফুটপাত দখল করে দুই শতাধিক শতাধিক দোকান রয়েছে । যার ফলে প্রতিদিন বড় জ্যামে পরে
থাকতে হয় এলাকাবাসি ও স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের । এদিকে ধোলাইপাড়ের শেষ মাথায় অবৈধ
অটোরিকশা স্ট্যান্ড আরো বিপদে ফেলছে এলাকাবাসিকে ।
কদমতলী থানার জুরাইন মেডিকেল রোড থেকে বিক্রমপুর
প্লাজা পর্যন্ত এবং জুরাইন আলম মার্কেট থেকে সেতু মার্কেট রাস্তায় শ’দেড়েক
দোকান রয়েছে। রাজধানীর গুলিস্তান ও বায়তুল
মোকাররম এলাকায় ফুটপাত, সড়ক এবং
অলিগলির রাস্তায় প্রায় আড়াই হাজার দোকান বসছে।
খিলগাঁওয়ের শহীদ বাকী সড়কের পশ্চিম মাথা থেকে শুরু করে তালতলা হয়ে
মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ পর্যন্ত এক দশমিক এক কিলোমিটার রাস্তার দুইপাশে প্রতিদিন
স্ট্রিট ফুডের ৩০-৩৫টি গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্যের শতাধিক ভ্যান বসে। ফলে একশ’
ফুটের প্রশস্ত রাস্তার মাত্র ৫০ থেকে ৬০ ফুট যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত
থাকে। রাস্তা দখল করে বসা অবৈধ দোকানিদের অবাধ বাণিজ্যের কারণে শুক্রবারসহ বিভিন্ন
ছুটির দিনে ব্যস্ততম এ সড়কটি আরও সংকীর্ণ হয়ে সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট।
একই অবস্থা মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে ভাষানটেক পর্যন্ত গোটা সড়কের। ১০০
ফুট প্রশস্ত এ রাস্তার দু’পাশের অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে
অবৈধভাবে মালামাল রেখে সেখানকার দোকানিরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছেন। এতে সামান্য
গাড়ির চাপ বাড়লেই ওই সড়ক দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। অথচ ভাষানটেক থানা এ সড়ক সংলগ্ন
হওয়ায় পুলিশের গাড়িগুলোকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অবৈধ দখলদারদের স্তূপকৃত মালামালের পাশ
কাটিয়ে যেতে হচ্ছে।
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, শুধু শহীদ বাকী সড়ক কিংবা ভাষানটেক রাস্তাতেই নয়,
ঢাকার ব্যস্ততম প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির প্রতিটি রাস্তার
দু’পাশের বড় অংশ হাজার হাজার অবৈধ
দোকানির দখলে। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা ভাড়ার বাণিজ্য চলমান থাকলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের পর তা আরও বেড়েছে। আগে যে সড়কে ৭৫ থেকে ৮০টি অবৈধ দোকান বসত, তা এখন শ’য়ের কোটা ছাড়িয়েছে। আসন্ন রমজানে প্রতিটি রাস্তায় অতিরিক্ত আরও ২০
থেকে ২৫ শতাংশ অবৈধ দোকান বাড়ানোর জন্য এর নেপথ্যের গডফাদাররা জোরেশোরে প্রস্তুতি
নিচ্ছে। এতে নগরীর অধিকাংশ সড়কে ঈদের আগ পর্যন্ত যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ
নেবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
এদিকে রমজানে ইফতারির পণ্য ও ঈদের পোশাকসহ বিভিন্ন
মালামাল বিক্রির জন্য রাস্তা দখল করে নতুন দোকান বসানো নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক
নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে নতুন শত্রুতা দানা বাঁধছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, এ নিয়ে তাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে
পারে। যা এরইমধ্যে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে।
গোয়েন্দারা জানান, রাজনৈতিক
নেতাকর্মী, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা শুধু অবৈধভাবে রাস্তা ভাড়া
দিয়ে চাঁদা তুলছে তাই-ই নয়, অনেক জায়গায় এখন এসব স্থানের ‘পজিশন’ বিক্রি
হচ্ছে। জায়গার গুরুত্বভেদে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা, এমনকি কোথাও
কোথাও ৫ লাখ টাকায় পজিশন বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাস্তা দখল করে অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার বিষয়টি থানা
পুলিশ, সিটি করপোরেশন ও জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন দপ্তরে
জানানো হলেও তারা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াচ্ছে। তবে স্থানীয়
লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে এসব রাস্তা দখলকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাদের আসল
স্বরূপ প্রকাশ পাচ্ছে। তখন তারা তাদের প্রতিবাদে সহযোগিতা না করে বরং অবৈধ
দখলদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এদিকে সংকীর্ণ রাস্তার যানজটে
পড়ে যান্ত্রিক যানবাহনের গতি মন্থর হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিন অযথাই হাজার হাজার লিটার
সিএনজি, এলপিজি, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন পুড়ছে। নষ্ট হচ্ছে যানবাহনের যাত্রীদের মূল্যবান
কর্মঘণ্টা। অস্বাভাবিক যানজটের কারণে তাদের গণপরিবহণে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও
জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,
রাস্তার পাশে ছোট চৌকি, ভ্যান ও চাকাওয়ালা
ঘুন্টিঘর বসিয়ে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ অবৈধভাবে ব্যবসা করছে। তবে এদের কাছ থেকে
যারা অবৈধভাবে টাকা তুলছেন তাদের নেপথ্যের গডফাদার মাত্র ৩ থেকে ৪শ’।
যদিও তাদের প্রত্যেকের ১০ থেকে ১৫ জন করে লাইনম্যান রয়েছে। যারা প্রতি মাসে ১৫০
থেকে ১৬০ কোটি টাকা রাস্তা ভাড়া তুলে চাঁদাবাজচক্রের মূল হোতাদের হাতে তুলে
দিচ্ছে। এ টাকা থানা ও ফাঁড়ির পুলিশ,
ট্রাফিক পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা,
স্থানীয় সন্ত্রাসী ও সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের
মধ্যে ভাগ হচ্ছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড
ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অবৈধ দোকানিদের কাছ থেকে বছরে ১ হাজার ৮২৫ কোটি
টাকা চাঁদা আদায় হয়। যা চলে যায় দখলবাজ সিন্ডিকেটের পকেটে। এই বাণিজ্য ঘিরে হামলা,
সংঘর্ষ, এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, মানবিক কারণে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা রাস্তা থেকে
অবৈধ পণ্য বিক্রেতাদের তুলে দিচ্ছে না এমনটা দাবি চাউর করলেও পুরোটাই ‘ধান্ধাবাজি’
কথাবার্তা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, স্থানীয়
সন্ত্রাসী, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের চাঁদা না দিয়ে ঢাকার কোনো
রাস্তায় একটি অবৈধ দোকানও বসতে পারে না। রাস্তার ভাড়া আদায়ের নামে তারা উল্টো
দরিদ্রদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। গডফাদারদের সুযোগ না দিয়ে বরং টেন্ডারের মাধ্যমে
ইজারা দেওয়া হলে রাস্তা দখল করা দোকানিদের কম ভাড়া গুনতে হতো। পাশাপাশি সরকারি
কোষাগারেও বড় অঙ্কের অর্থ জমা পড়ত। রাস্তা থেকে অবৈধ দখলদার তুলে দিতে না পারাটাকে
প্রশাসনের দুর্নীতিজনিত ব্যর্থতা বলেও মন্তব্য করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, অবৈধ কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা প্রমাণ করে
তারা কোনো না কোনোভাবে এসবের সঙ্গে জড়িত। অবৈধ দখলদারদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে
পারছে না বলেই রাস্তার একটি বড় অংশ বেদখল হয়ে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনো
কখনো মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারের যেসব সংস্থা
বা কার্যালয় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনলেই এসব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন
এ পরিকল্পনাবিদ।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর
বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, যানজটের কারণে ঢাকা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।
এজন্য প্রশাসনের ব্যর্থতা দায়ী। তারা সঠিকভাবে কাজ করে না। তিনি আরও বলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার আইনগতভাবে সেটা
নিশ্চিত করবে। কিন্তু মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে তো ব্যবসার সুযোগ দিতে পারে না।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন রাস্তা থেকে অবৈধ
দোকানিদের উচ্ছেদে তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে নানা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করছে। সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষের দাবি, সিটি
করপোরেশনকে নগরীর রাস্তা-ফুটপাত পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্ত রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে পুলিশ ফোর্স বিশেষ প্রয়োজন। যা
সিটি করপোরেশন প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারবে। সেটা না থাকায় ডিএমপির পুলিশ
নিয়ে সিটি করপোরেশন অবৈধ দোকানিদের উচ্ছেদ করে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা আবার বেদখল হয়ে
যাচ্ছে।
ডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের মাঠ পর্যায়ের দু’একজন
সদস্য রাস্তার অবৈধ দোকানিদের কাছ থেকে উৎকোচ নিতে পারে। তবে ঢালাওভাবে সবাইকে
অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা সরাসরি তদারকি করে
বিভিন্ন রাস্তা থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু লাভের লাভ তেমন কিছুই হয়নি।
কারণ তারা উচ্ছেদ অভিযান থেকে সরে আসার পরপরই স্থানীয় প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীরা
ফের সেখানে দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায় করছে। ফুটপাত ও রাস্তায় অবৈধ দোকান বসিয়ে
লাইনম্যানরা ভাড়া তুললেও তা স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের পকেটে যাচ্ছে
বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।