মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, গবেষক :
- আজ
অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা প্রবাহে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ মাস মার্চ। ১৯৭১ সালের এ মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের
সাক্ষী অগ্নিঝরা মার্চ। ১৯৭১ সালের এই মাসে তীব্র আন্দোলনের পরিণতিতে শুরু হয় মহান
স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ মূলত দিনটি বাঙালির স্বপ্নসাধ
যৌক্তিক পরিণতির মাস শুরুর। ১৯৭১ সালে এসে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে, যদিও তার গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু বছর আগে।
তারপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের শিক্ষা
আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাঙালির সেই
স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতি স্পর্শ করে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের গহীনে লালন করা তখনো
অধরা ‘স্বাধীনতা’ যেন
অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
তুমি যে সুরের আগুন ছড়িয়ে
দিলে মোর প্রাণে, সেই আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে, সবখানে’,
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্রষ্টা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম
স্বাধীনতার সংগ্রাম’ স্বাধীনতার অমর
কাব্যের এই পঙ্ক্তিটি বাঙালি জাতিকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় বলীয়ান করে তোলে।
এই
মার্চেই পাকিস্তানকে বাঙালি বিদায় সম্ভাষণ জানায়। পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ রাতে
কামান, মর্টার, রাইফেল নিয়ে অতর্কিতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির
ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু তখন গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে তার সর্বশেষ
বাণী বাংলার মানুষের কাছে পাঠান এই বলে, ‘এই হয়তো তোমাদের জন্য
আমার শেষ বাণী। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থেকে থাকো, যে অবস্থায়ই থাকো,
হাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষনিঃশ্বাস
পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলো। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে, যতদিন না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত
হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে। ’
বঙ্গবন্ধুর
এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল বাঙালি জাতি। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর
স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপট শুরু হয় মার্চের প্রথম দিন থেকে। এদিন পাকিস্তানের
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। দুপুর ১টা
৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের সব কেন্দ্রে একযোগে প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা প্রচার করা
হয়।
আগের
ঘোষণা অনুযায়ী ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় হওয়ার কথা ছিল। এই ঘোষণার মধ্য
দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় দেশ আবার কঠোর সামরিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে এবং সামরিক আইন
কঠোর করে ভেতরে ভেতরে কোনো গভীর প্রস্তুতি চলছে।
দুপুরে
রেডিওতে যখন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল, তখন ঢাকা
স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান ও বিশ্ব একাদশের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট
প্রতিযোগিতার ধারা বিবরণী চলছিল। তাই মাঠের ক্রিকেট দর্শকরাই রেডিওতে প্রথম
ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা শুনতে পান। রেডিওতে খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম সংঘটিত
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে স্টেডিয়ামের হাজার হাজার ক্রিকেট দর্শক। তারা সমস্বরে
চিৎকার করে ওঠেন ‘জয় বাংলা’
বলে। তারা ধাওয়া করেন পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের এবং স্লোগানে
উত্তাল হয়ে মিছিল নিয়ে নেমে পড়েন রাজপথে।
জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের খবর শুনে পিআইএ’র বাঙালি কর্মচারীরাও
জনসাধারণের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়েন। জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী তৎকালীন
কায়েদণ্ডই-আজম কলেজের (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ছাত্ররাও লাঠিসোটা হাতে
রাস্তা প্রদক্ষিণ করতে থাকে। আদমজী মিলের শ্রমিকরা চাকা বন্ধ করে শোভাযাত্রা নিয়ে
রাস্তায় বেরিয়ে আসেন।
মিছিলকারীরা
সে সময় বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন এ খবর জানতে চান। অবশেষে তারা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু
এখন হোটেল পূর্বাণীতে। সেখানে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক হওয়ার
কথা। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে হোটেল অভিমুখে।
লাখ
লাখ মানুষের চিৎকার আর মিছিলে হোটেল পূর্বাণীর চত্বর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সবাই
বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশ শোনার জন্য উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু
সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এক্ষুনি চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
গ্রহণের জন্য তিনি মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ,
আতাউর রহমান খানসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনা করবেন।
তবে
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, অধিবেশন স্থগিত হওয়ার বিষয়টি তিনি বিনা চ্যালেঞ্জে
যেতে দিতে পারেন না। তিনি বলেন, আগামী ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স
ময়দানে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। ২
মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ বুধবার সারা দেশে হরতাল পালিত হবে।
বঙ্গবন্ধুকে
সাংবাদিকরা জানান, জনগণ তো রাস্তায় নেমে পড়েছে, তিনি তাদেরকে কী বলবেন?
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ
থাকতে এবং যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বলব।’
এরই
মধ্যে শহরের বিভিন্ন অলিগলি থেকে শত শত মিছিল পল্টন ময়দানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে
জমায়েত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এই জমায়েত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত
ছাত্রলীগের সমাবেশে বক্তৃতা করেন সাবেক ছাত্রনেতা ও নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য
তোফায়েল আহমেদ।
তিনি
বলেন, আর ৬-দফা, ১১-দফা নয়, এবার
বাংলার মানুষের ১-দফার সংগ্রাম শুরু করব। আর এই ১-দফা হচ্ছে বাংলাদেশের
সার্বভৌমত্ব।
তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ
জাদুঘর ও ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র