আগামী বছরে হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। চলতি বছরটি তাই নির্বাচনের প্রস্তুতির। এরই মধ্যে জোট গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোতে শুরু হয়েছে নীরব প্রতিযোগিতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক চাঙা করতে বৈঠক করেছে। আবার সংসদ নির্বাচনের পর নিষ্ক্রিয় বিএনপিও ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি সমমনাদের পাশাপাশি ইসলামি দল নিয়েও জোটের কথা ভাবছে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বাম প্রগতিশীল দলগুলোও। ফলে রাজনীতি এখন ঘুরছে ভোটকেন্দ্রিক জোটের আবর্তে।
আওয়ামী লীগ : টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকা দলটি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। গত মঙ্গলবার শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে। বৈঠকে রাজনীতির মাঠের কর্মকৌশল নির্ধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৪ দল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকে ১৪ দলীয় জোটের শরিক নেতারা ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিএনপি-জামায়াতসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী চক্র স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথা ছাড়া দিতে পারে। এ বিষয় মাথায় রেখে জোটকে রণকৌশল ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন জোটপ্রধান শেখ হাসিনা। এ সময় রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু আগামী নির্বাচনের রূপরেখা ও জোটগতভাবে হবে কি না এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। জবাবে শেখ হাসিনা ১৪ দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেন। জোটের শরিকদের সক্ষমতা বাড়াতে নির্দেশ দেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বৈঠকে চলমান সমসাময়িক সব বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। বিশেষ করে নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৪ দলকে জোটগতভাবে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘দীর্ঘদিন পরে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সবাই নির্বাচনের বিষয়ে নেত্রীর কাছে দিকনির্দেশনার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। নেত্রী নির্বাচনের আগে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করতে ১৪ দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপি : এবার নতুন মিত্রের সন্ধানে নেমেছে দলটি। জোরদার করা হয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা। পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক চাঙা করার চেষ্টাও করছে দলটি। সমমনা সব দল ও মতকে নিয়ে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার তৎপরতাও চালাচ্ছে। তাতে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো পুরোনো জোট কাঠামো নাও থাকতে পারে। আসতে পারে চমক। লক্ষ্য আগামী জাতীয় নির্বাচন ও সরকার পতন আন্দোলন। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি সমমনা বাম, ডান ও ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিএনপি। দলগুলোর কয়েকটি জোটে যোগ দিতে আগ্রহও দেখিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শেষ সময়ে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতি ও হিসাব-নিকাশ চলছে। কিন্তু কোনো দলই এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। আলাপকালে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
বিএনপির নেতারা বলছেন, নতুন জোট গঠন ও আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে বিএনপি। প্রাথমিকভাবে অনেক দল স্ব স্ব দলীয় ব্যানারে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়েও একমত হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হতে আরো কিছু সময় লাগবে। চলতি মাসের শেষ দিকে বা এপ্রিল মাসের শুরুতে আসতে পারে বৃহৎ জোটের ঘোষণা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের লক্ষ্য, সমমনা ডান-বামসহ সব রাজনৈতিক দল ও মতকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসা। তারপর সরকার পতনের আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটনা। রাজপথে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, বিএনপি এ মুহূর্তে সেভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করছে না। জামায়াতে ইসলামীও কোনো কর্মসূচি পালন করছে না। যে কারণে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে টুকটাক কর্মসূচি হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে যাদের আসার তারা আসছেন। বড় ধরনের জনসভা বা সে রকম কর্মসূচি এখন হচ্ছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক ছাড়া বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি। যুগপৎ আন্দোলনে সবাই শরিক থাকবে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে।
জাতীয় পার্টি : জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সবকিছুই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংসদের এই প্রধান বিরোধী দলটি। সরকার ও বিরোধীদের দুই শিবিরেই সঙ্গে সমান তালে যোগাযোগ রাখছে। পাশাপাশি ইসলামি দলগুলো নিয়ে জোটের কথা ভাবছে।
বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল : বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি প্রায় ৩ ঘণ্টা বৈঠকও হয়েছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সহসভাপতি তানিয়া রব, সাম্যবাদী দলের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জগলুল হায়দার আফ্রিক, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, গণফোরামের আরেক অংশের কেন্দ্রীয় নেতা মোশতাক আহমেদ বৈঠকে ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।
জানা গেছে, বাসদের সদস্য সমাপ্ত কংগ্রেসের পর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নৈশভোজের নামে মিলনমেলা হয়ে ওঠে বাম ঘরানার দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য গড়ার আলোচনার কেন্দ্র।
গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বাম দলগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়র চেষ্টা চলছে। আমরা আর আওয়ামী লীগণ্ডবিএনপির ফাঁদে পা দিতে চাই না। আমরা চাই বিকল্প শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে। ধরে নিতে পারেন, এই বৈঠক সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। আমরা চাই একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এই দাবিতে বাম প্রগতিশীলদের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি।
এদিকে বিগত নির্বাচনে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও আশানুরূপ সফলতা পায়নি। বিএনপির সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ঐক্য নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকরা ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন সময় তারা এই ক্ষোভ দেখিয়েছেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগণ্ডবিএনপির বাইরে বাম দলগুলো বৃহত্তর ঐক্যের মধ্য দিয়ে বিকল্প শক্তি হিসাবে রাজনীতির মাঠে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে। এই চেষ্টার অংশ হিসাবে অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং ৯টি বাম রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সঙ্গেও প্রাথমিক আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক করেছেন বাম প্রগতিশীল ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ভোট এলেই জোট বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ জোট হওয়ার পেছনে আদর্শের কোনো প্রেরণা কাজ করে না। ছোট দলগুলো বড় দলের আশপাশে, বিশেষ করে যাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করে।