মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক লেখক ও গবেষক ঃ
মাঝে মধ্যে কোনভাবেই আর ধৈর্য্য রাখতে পারি না। আর কতো সহ্য করা যায়? প্রায় দুই ঘন্টা বাড্ডা লিংক রোড মোড়ে স্থবির হয়ে আটকে ছিলাম । সহ্য করতে না পেরে বৃষ্টি কাঁদায় হেঁটে অফিসে ফিরেছি। শুধুমাত্র যানজটের কারণে এই শহর ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এভাবে আর কতো?
আচ্ছা আজ যে মানুষটার হাসপাতালে যাওয়ার কথা, হালকা স্ট্রোক করে অ্যাম্বুলেন্সে যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা বসেছিলেন, যে শিশুটির স্কুলে যাওয়ার কথা পরীক্ষা দিতে, ফ্লাইট ধরার কথা যাদের, অফিসে যাওয়ার কথা যার, কী অবস্থা তাদের সবার? আফসোস একটা শহরকে আমরা মৃত বানিয়ে ফেলেছি তারপরও উন্নয়নের গল্প শেষ হয় না।
ভাবুন তো কী এক অদ্ভুত শহর! আপনি বরিশাল কিংবা খুলনা গোপালগঞ্জ থেকে শত শত কিলোমিটার পথ পদ্মা সেতু পেরিয়ে চলে আসবেন দুই ঘন্টায় কিন্তু গুলিস্তান থেকে মিরপুর বা মিরপুর কতো ঘন্টায় যাবেন সেটা বলার শক্তি নেই কারো। কারণ এই শহরে গাড়ির গতি এখানে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। অথচ ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার৷ এক যুগের ব্যবধানে সেটি পাঁচে নেমে এসেছে।
মনে রাখবেন, আপনার যতো দামী গাড়িই হোক, বাসে বা উবারে যেভাবেই যান, ঘন্টায় আপনি পাঁচ কিলোমিটারের বেশি যেতে পারবেন না। অথচ পায়ে হেঁটেও একই গতিতে চলা যায়। কিন্তু হাঁটার পরিবেশও কী আছে? হাঁটতে গেলে দেখবেন, ফুটপাতগুলো তো প্রায় সব বেদখলে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের নীতি নির্ধারকদের বলি, একটু পাবলিক বাসে বা সিএনজিতে চড়েন। এই শহরের পাবলিকের কষ্টটা বোঝেন।
এই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি, এই নগরবাসীর শারীরিক মানসিক নানা সংকট তৈরি হচ্ছে এর দায় কার? আমি তো বলবো, এই শহরের মানুষের পারিবারিক বা সামাজিক বহু অশান্তির কারণ এই যানজট। এই শহরের বহু মানুষ সকালে বের হয় আর রাতে বাসায় ফেরে। পথে যানজটে যায় ৬-৭ ঘন্টা। এটা কী কোন নাগরিক জীবন?
বুয়েটের এক গবেষণায় বলছে, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়৷ আর এই যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ১১ ভাগের এক ভাগ৷ ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ১৯৮০ সালে গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার এবং এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটারেরও কম। এতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ২০৩৫ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ মিলিয়নে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২০১৩ সালে তার এক গবেষণায় দেখানো হয়, শুধু যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্টের জন্য বছরে ক্ষতি হয় ১২ হাজার কোটি টাকা৷ শুধুমাত্র গণপরিবহণ ব্যবস্থা ভালো নয় বলেই এই শহরে অনেকে ধার করে বা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটি গাড়ি কেনে। কিন্তু তাতে লাভটা কী হয়? যতো দামী গাড়ি হোক বাসের বদলে নিজের গাড়িতে যানজটে বসে থাকতে হয় এই যা!
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই শহরে ট্রাফিক সিগন্যাল বলে কিছু নেই। অথচ ছোটবেলায় আমি দেখেছি এই শহরে ট্রাফিক সিগন্যাল ছিল। লাল-সবুজ বাতি কাজ করতো। এখন সব বৃথা। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। আচ্ছা প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে প্রতিটা রাস্তার প্রতিক্ষনের অবস্থা দেখা যায় সেখানে কী যানজটের সমাধানে প্রযুক্তির ব্যবস্থা নেয়া যায় না?
আমাদের নীতি নির্ধারকদের বলবো, একটু ভাবুন। যানজট সমস্যা দূর করা খুব কঠিন কাজ বলে মনে করি না। কিন্তু আমরা যদি মনে করি সমাধান নেই আর এটাই মেনে নিতে হবে তাহলে তো আমরা শেষ!
আপনারা যারা সরকারের নীতিনির্ধারক, আপনাদের দোহাই লাগে আপনাদের কাছে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান কিছু চাই না। শুধু যানজট থেকে মুক্তি দিন। দেখেন দয়া করে কোটি কোটি টাকার যত্রতত্র পরিকল্পনা নেবেন না। এইসব বিআরটি এইসব ফ্লাইওভার অর্থহীন। দয়া করে গণপরিবহনে নজর দিন।
আচ্ছা আপনারা যারা নীতি নির্ধারক তারা কি ঢাকার পাবলিক বাসগুলোর চেহারা দেখেছেন? চড়েছেন? সস্তা জনপ্রিয় বুলি না আওড়ে প্লিজ সমাধান খুঁজুন।
আমি এখনো মনে করি ঢাকার বিভিন্ন রূটে কয়েকশ করে নতুন পাবলিক বাস নামলে, পাঁচ মিনিট পরপর এসি বাস ছাড়লে লোকে অন্তত সেই বাসে চড়বে। নীতি নির্ধারকেরাও এসব বাসে চলুন। কয়েকদিন ব্যক্তিগত গাড়ি সব বন্ধ করে দেখেন। ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে দেন। আর সিগন্যালিং সিস্টেমটা ঠিক করুন।
সত্যি বলছি ভীষণ যন্ত্রনা লাগে! নীতি নির্ধারকদের কাছে তাই হাতজোড় করে অনুরোধ যানজটের রোজকার এই যন্ত্রণা থেকে আমাদের নগরবাসীকে মুক্তি দিন! গণপরিবহন ব্যবস্থা ঠিক করুন নয়তো রাজধানী সরিয়ে নিন। বিকেন্দ্রীকরণ করুন বা অন্য যে কোন কিছু। দয়া করে এই নগরবাসীকে তিলে তিলে শেষ করে দেবেন না! আপনাদের দোহাই লাগে!