পুলক ঘটক, সিনিয়র সাংবাদিক :
তুমি যাকে শিরক বলছ, তা আমার কাছে ধর্ম। তুমি মেনো না, কিন্তু আমাকে বাধা দিবে কেন? তুলনা করলে বা প্রতীক বানিয়ে উপাসনা করলে আমার ঈশ্বর ক্ষিপ্ত হয় না। এ কাজ আমার ধর্মের ঈশ্বরের কাছে কোনো অপরাধ নয়; আমার কাছেও অপরাধ নয়। আমার বিবেচনায় ঈশ্বর উপাসনার সকল পন্থাই বরং উত্তম। এ কোনো ক্রাইম নয়।
ঈশ্বর কেমন, তাঁর চরিত্র কেমন, কিসে তিনি ক্ষিপ্ত হন, কিসে তিনি রাগান্বিত হন ইত্যাদি সম্পর্কে সব ধর্মের বর্ণনা এক রকম নয়। যেমন সনাতন ধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বর জগৎ ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন দূর আকাশের কোনো শক্তি বা বস্তু নন। তিনি আকাশ থেকে শাসন করা রাজা নন। তিনি আকাশেও আছেন, মাটিতেও আছেন। তিনি জীবন ও জগতের সাথে মিশে আছেন –সৃষ্টির পাতায় পাতায় মিশে আছেন। এর বাইরেও তাঁর স্বতন্ত্র সত্তা আছে। তিনি একাধারে এক এবং বহু; তিনি একাধারে নিরাকার এবং সাকার। তাঁর কোনো শেষ নেই। জল যেমন বাষ্প হতে পারে, আবার বরফের মতো আকৃতি নিতে পারে; তেমনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সব হতে পারে। নিরাকার হতে পারে, সাকারও হতে পারে। এক হতে পারে, আবার বহুরূপও হতে পারে। তাই সব রূপের মাঝেই তাঁকে সন্ধান করা বা তাঁর উপাসনা করা সনাতন ধর্মে অপরাধ নয়, বরং ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের পন্থা।
"বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর" –সনাতন ধর্মের অমোচনীয় বাণী। এখন আমি যদি এটা বিশ্বাস করি এবং এভাবে উপাসনা করি, এজন্য তুমি কি আমার উপর অত্যাচার করবে? আমার উপাসনার স্থান ক্ষতিগ্রস্ত করবে? কেন করবে? আমি তো তোমাকে এভাবে উপাসনা করতে বলিনি! তুমি তোমার বিশ্বাস অনুযায়ী এবাদত কর। কিন্তু আমার ঈশ্বর উপাসনায় তুমি বাধা দাও কেন?
"ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়” –এটি আমার মৌলিক ধর্মীয় দর্শন। ঈশ্বর সর্বব্যাপী এবং প্রকৃতির সবকিছুতেই ঈশ্বরের উপস্থিতি –এ আমি বিশ্বাস করি।
"আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে, ভূধর সলিলে, গহনে;
আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়, শশী তারকায় তপনে।"
–ঈশ্বরকে আমি এভাবে দেখি; সর্বত্র দেখি।
মাদারীপুরে যে বট গাছটি তোমরা কেটে ফেলেছ, তার মধ্যে ঈশ্বরের বিশেষ উপস্থিতি আমি অনুভব করি। অসীমের এক প্রবল উপস্থিতির সন্ধানে সেখানে গিয়ে আমি শ্রদ্ধায় নিরব হই; অথবা প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করি। আমি তো তোমার ক্ষতি করি না। এ আমার বিশ্বাস, আমি আমার মতো চলি। আমি তোমাকে বাধা দেইনি, বা তোমাকে সেখানে গিয়ে উপাসনা করতে বলিনি। তাহলে তুমি প্রকৃতির এই গাছটি কাটবে কেন? তুমি শুধু প্রকৃতির ক্ষতি করনি, তুমি আমার উপরেও জুলুম করেছ।
হিমালয় থেকে সাগর পর্যন্ত যেখানেই বৃহৎ কিছু, সেখানেই আমার (ঈশ্বরের) বৃহৎ উপস্থিতি। গ্রহ, নক্ষত্র, হাতি, ঘোড়া, কচ্ছপ সবকিছুর মধ্যে যা কিছু বৃহৎ, তা আমার (ঈশ্বরের) বিশেষ উপস্থিতিতে বা বিভূতিতে বৃহৎ –এটা বেদ, উপনিষদ ও গীতার ঈশ্বর শিখিয়ে গেছে। আমি এই শিক্ষায় ও এই বিশ্বাসে গড়ে ওঠা। তুমি আরেক রকম শিক্ষায় ও আরেক রকম বিশ্বাসে গড়ে ওঠা। এজন্য আমি তোমাকে বাধা দেবো না, তুমিও আমাকে বাধা দেবে না –এটাই তো সংস্কৃতি হওয়া উচিত।
হ্যাঁ, আমার বিশ্বাসের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা, এবং তোমার বিশ্বাসেরও যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা হতে পারে। সেটা সবাই করতে পারে, গণতান্ত্রিক সহনশীলতার সাথে। সত্য সন্ধান এবং জ্ঞান বিস্তারের জন্য আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা দরকার আছে। মিথ্যা বিশ্বাসগুলো যুক্তির দ্বারা অপনোদনের প্রয়োজন আছে। সুতরাং আমি ধর্মেরও সমালোচনার পক্ষে। কিন্তু একজনেরটা আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেয়ার বা জুলুম করার পক্ষে না। অন্যরা উপাসনা করে জন্য তার গাছটা কেটে ফেলার পক্ষে না।
ঈশ্বর এমন হিংসাত্মক কেন হবেন, বা তার অনুসারীদের এমন হিংস্র আচরণ কেন করতে বলবেন? তাঁকে কখনো সামনাসামনি দেখতে না পাওয়ায় নিছক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কে কিভাবে তাঁর উপাসনা করে –তাতে যদি অদেখা ঈশ্বরের মনে রাগ হয়ে থাকে, তবে তিনি নিজে সে জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। সেই জাতির মানুষের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা রহিত করে দিতে পারেন। অথবা তিনি সহজেই দেখা দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভ্রান্তি নিরসন করে দিতে পারেন। দেখা না দিয়েও ঈশ্বর মানুষকে বদলে দিতে পারেন, কারণ তিনি সর্বশক্তিমান। মানুষের কোন উপাসনা পদ্ধতিতে তাঁর আপত্তি থাকলে সে মানুষকে বদলে দেওয়া ঈশ্বরের নিজের দায়। সেই দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে মানুষ হয়ে মানুষের উপর উৎপীড়ন করা অপরাধ।
আমার মতে ঈশ্বরকে এমন নিষ্ঠুর ও হিংসাত্মক চরিত্রের ভাবাটাও ন্যায়সঙ্গত নয়। তাঁর সাথে কারও তুলনা করলেই ঈশ্বর হিংসায় ফেটে পড়বেন – এমন হিংসুক স্বভাবের একজন মানুষের মতো চরিত্র ঈশ্বরের উপর আরোপ করলে তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার করা হয় না। তাঁর প্রতিমূর্তি রচনা করে তাঁর উপাসনা করলে তিনি ব্যাপারটিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে না দেখে হিংসার চোখে দেখবেন– ঈশ্বরের চরিত্র এমন হতে পারে না। এ আমি বিশ্বাস করি না; এটা আমার বিশ্বাসের ধরন। এভাবে বিশ্বাস করা আমার অপরাধ নয়।
আমরা আমাদের শ্রদ্ধার ও প্রিয়জনের মূর্তিতেই আমাদের ভালবাসা দেই; ফুল দেই; আলো জ্বালাই। এতে আমার প্রিয়জন ক্ষিপ্ত হতে পারে না। ঘরে মা ও বাবার ছবি/মূর্তি শ্রদ্ধার সাথে রেখেছি –এজন্য আমার প্রতি পিতামাতার স্নেহ নষ্ট হওয়ার কথা নয়। আমার প্রিয়ার ছবি আমার মানিব্যাগে রেখেছি জন্য ঐ ছবিটির প্রতি হিংসায় আমার প্রিয়তমা জ্বলে উঠবে না।
যতক্ষণ দেখিনি ততক্ষণ ঈশ্বর কাল্পনিক বটে। জাগতিক বা কাল্পনিক কোন কিছুর সাথে সেই ঈশ্বরের তুলনা করলে বা তাঁর ছবি বা মূর্তি রচনা করলে সেই বস্তু বা প্রতীকটির প্রতি ঈশ্বর হিংসা করবেন –ঈশ্বরের চরিত্র আমার কাছে এমন মনে হয় না। যে কোনো প্রকার তুলনায় বা প্রতিমূর্তি রচনায় শিরক হয়ে যাবে; ধর্ষণ, হত্যা, নিরীহ মানুষের খাবার কেড়ে নেওয়া, জুলুম, নির্মম অত্যাচার ইত্যাদির চেয়ে বড় অপরাধ হয়ে যাবে– আমার ধর্ম বিশ্বাস এমন নয়।
এই যে আমার ধর্ম বিশ্বাস, একে ভুল প্রমাণের জন্য আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন। কিন্তু এজন্য আমার উপর হামলা করতে পারেন না, জোর-জুলুম করতে পারেন না এবং আমার উপাসনার উপাদানকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেন না। আসুন সভ্য ও গণতন্ত্রী হই; আলোচনায়-পর্যালোচনায় সত্য সন্ধান করি। ধ্বংস ও অত্যাচারের পথ সঠিক নয়।