সম্প্রতি বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তে ওপারে ভারতের সুখদেবপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। গত ৬ জানুয়ারির পর কুঁড়িগ্রাম ও নওগাঁ সীমান্তের ওপারেও কাঁটাতারে বেড়া তৈরির চেষ্টা করে বিএসএফ। মোট পাঁচটি পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অভিযোগ করে বার্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) । তবে বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে শনিবার (১১ জানুয়ারি) বেড়া নির্মাণ বন্ধ করে দেয় বিএসএফ।
উত্তেজনার সময় বাংলাদেশের সীমন্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি বাংলাদেশে সীমান্তে টহল বাড়িয়ে দেয়। বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষও পাহারায় অংশ নেয়। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এখন কোনো উত্তেজনা নেই এবং পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ফটোকার্ড প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “সীমান্তে সংঘর্ষ: বাংলাদেশি আহত ১: ভারতের নিহত ১৮ জন”। উক্ত ফটোকার্ড প্রচার করা কিছু পোস্টের ক্যাপশনে দাবিকৃত নিহত ১৮ জন সদস্যকে বিএসএফ সদস্য বলে দাবি করা হয়েছে।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করলেও কোনো সংঘর্ষে ১৮ জন বিএসএফ সদস্য নিহত হওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে কোনোরকম নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ফটোকার্ড পর্যবেক্ষণ করলে প্রচারিত ফটোকার্ডে কোনো গণমাধ্যমের লোগো বা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সাধারণত কোনো গণমাধ্যম কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করে থাকলে, প্রচারিত ফটোকার্ডে গণমাধ্যমটির নাম বা লোগোর সংযুক্তি থাকে৷ তবে, প্রচারিত উক্ত ফটোকার্ডটিতে এমন কোনো গণমাধ্যমের নাম বা লোগোর উল্লেখ পাওয়া যায়নি, যা থেকে বুঝা যায় যে আলোচিত ফটোকার্ডটি গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়নি।
তবে, কিছু পোস্টের মন্তব্য সেকশনে দৈনিক নগর বার্তা নামের একটি ওয়েবসাইটে গত ১১ জানুয়ারিতে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করলে কথিত সংবাদটির ফিচারে আলোচিত দাবির ফটোকার্ডটির সংযুক্তি পাওয়া যায় যেখানে লেখা রয়েছে ‘বিস্তারিত কমেন্টে’।
কথিত এই সংবাদ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সংঘটিত এক সশস্ত্র সংঘর্ষে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে কর্তব্যরত বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে বিএসএফ সদস্যদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে বাংলাদেশি এক বিজিবি সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন, এবং ভারতের ১৮ জন বিএসএফ সদস্য নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত: সূত্র জানায়, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে কিছুক্ষণ অবস্থান করছিল। বিজিবি এ বিষয়ে আপত্তি জানালে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। বাংলাদেশি পক্ষের বক্তব্য বিজিবি’র এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, বিএসএফের পক্ষ থেকে প্রথমে গুলি চালানো হয়। আত্মরক্ষার্থে বিজিবি পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এতে ভারতের পক্ষ থেকে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতের আজাইরা প্রতিক্রিয়া: ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে দাবি করা হয়েছে, তাদের বাহিনীর সদস্যরা নিরস্ত্র অবস্থায় সীমান্তে টহল দিচ্ছিল। তাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। তবে এ অভিযোগ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে।
পরবর্তী অনুসন্ধানে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে, সাম্প্রতিক সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও লালমনিরহাটে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুইজন বাংলাদেশি আহত হওয়ার বিষয়ে জানা গেছে। এর সঙ্গে সীমান্তে কোনো সংঘর্ষের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। গত ১১ জানুয়ারিতে দেশের একটি প্রথম সারির সংবাদ পত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ গুরুতর আহত হয়েছেন।
গত ১০ জানুয়ারি রাতে উপজেলার আজমতপুর সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত তরুণের নাম মো. শহিদুল ইসলাম (২২)। ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, শিবগঞ্জের আজমতপুর সীমান্তের ওপার থেকে ফেনসিডিল নিয়ে আসার পথে ভারতের ভেতরে বিএসএফের গুলিতে শহিদুল ইসলাম আহত হন। পরে আহত অবস্থায় তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
এছাড়া, গত ১৩ জানুয়ারি আরেকটি সংবাদ পত্রে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে শহিদুল ইসলাম (৪২) নামে এক বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। গত শনিবার (১১ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিজিবি ও স্থানীয়রা জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মেইন পিলার ৮৫৯ নম্বরের ৪ নম্বর সাব পিলারের কাছে কাশিরডাঙ্গা এলাকা দিয়ে ভারত থেকে গরু আনছিলেন ৫-৬ জনের চোরাকারবারি দল। এ সময় সীমান্তে টহলরত ভারতের ১৬৯ রাণীনগর বিএসএফ ব্যাটালিয়নের বুড়াবুড়ি ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। এতে শহিদুলের পায়ে গুলি লাগে। তার সঙ্গীরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং রংপুরে একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য।
তবে, উক্ত কোনো ঘটনাতেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সংঘর্ষ বা ১৮ জন বিএসএফের নিহতের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সংঘর্ষে ১৮ জন ভারতীয় বা বিএসএফ সদস্য নিহত হয়েছেন শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।