মো: হ্নদয় হোসাইন,মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি :
যুগে যুগে দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিক শ্রেণির অবদান অনস্বীকার্য। আজকের এই সভ্য সমাজের উঁচু অট্টালিকা, শিল্প-কারখানা কিংবা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন—সবকিছুর পেছনেই মেহনতি মানুষের ঘামঝরা শ্রম নিহিত।
এই দিবসটির ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে ১৮৮৬ সালের শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেট’ আন্দোলনের মধ্যে। সেখানে শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এ দিনে অকুতোভয় কিছু শ্রমিক তাঁদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রমিকদের অধিকার, যা পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে শ্রম আইন ও ন্যায্য মজুরির আলোচনার পথপ্রদর্শক হয়। এই অবদানের স্বীকৃতি দিতেই প্রতিবছর ১ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা মে দিবস নামেও পরিচিত।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে শ্রমিক শ্রেণি। দেশের কল-কারখানা, নির্মাণশিল্প, পরিবহন খাত কিংবা কৃষি—প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমই গতি এনে দেয় অর্থনীতিকে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই শ্রমিকরাই সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও উপেক্ষিত। প্রতিনিয়ত তারা শোষণ, বঞ্চনা ও বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়, কর্মপরিবেশ থাকে অমানবিক, এবং নিরাপত্তার অভাবে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। পরিতাপের বিষয় হলো, এখনো শ্রমিকদের নিজেদের ন্যায্য মজুরি ও উপযুক্ত কর্মপরিবেশের জন্য রক্ত দিতে হয়। 
শোষণহীন সমাজ গঠনে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে কী ভাবছেন মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা? এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মো. হ্নদয় হোসাইন।
ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিভাগের ২০২২-২৩ বর্ষের শিক্ষার্থী সমাপ্তি খান বলেন, শ্রমিকরা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে সব শ্রেণির মানুষের প্রতি ন্যায্যতা ও মর্যাদা থাকা প্রয়োজন। যারা কঠোর পরিশ্রম করেন, তাদের কষ্ট যেন আমরা বুঝি। আমি বড় হয়ে এমন কিছু করতে চাই, যাতে নারী শ্রমিকরা ন্যায্য বেতন ও সম্মান পান।
অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্স ২০২০-২১ বর্ষের শিক্ষার্থী তৌকির আহমেদ বলেন, ১লা মে—আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এটি কেবল একটি তারিখ নয়, এটি এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রতীক, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিন।
এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই বিশ্বের সকল শ্রমিকদের প্রতি—যারা রোদে-পুড়ে, ঘামে-ভেজা শরীরে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখেন। যারা নির্মাণ করেন রাস্তা, ব্রিজ, ভবন—যাদের হাতে গড়ে ওঠে এক একটি জাতির অগ্রগতির ভিত। অথচ আজও আমাদের সমাজে অনেক শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—
১. শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় নীতিনির্ধারক ও নাগরিক সমাজ সক্রিয় থাকবে।
২. শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক হবে দায়িত্বশীল ও সম্মানভিত্তিক।
৩. শিশু শ্রম, জোরপূর্বক শ্রম ও শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে।
আমরা যেন ভুলে না যাই—শ্রমের মর্যাদা মানে মানুষের মর্যাদা। সমাজের প্রতিটি স্তরে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির মনোভাব গড়ে তুললেই শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য পূর্ণতা পাবে।
শ্রমিকের ঘামে গড়া সমাজে কোনো বৈষম্যের জায়গা নেই।
আসুন, এই দিনে আমরা সমতার সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাই।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রাকিব বলেন,আমি একজন শিক্ষার্থী। পড়াশোনার ফাঁকে যখন দেখি রোদে-পুড়ে, ঘামে ভিজে কাজ করছেন শ্রমিকরা—তখন মনে হয়, এ সমাজের সত্যিকারের নায়ক তো এঁরাই। আমরা যে ভবনে ক্লাস করি, যে রাস্তায় চলি, তা তো তাঁদের ঘামে গড়া।
তবু কেন তাঁরা থেকে যান প্রান্তে? কেন আজও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হন? কেন নিরাপদ কর্মপরিবেশ কিংবা সামাজিক সুরক্ষা তাঁদের প্রাপ্য হয়ে ওঠে না?
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আমাকে শেখায়—শ্রম মানেই সম্মান। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদের সবার। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার—শ্রমিক বললেই যেন সম্মান ঝরে পড়ে মনে।
শিক্ষার্থী হিসেবে আমি স্বপ্ন দেখি এক এমন সমাজের, যেখানে শিশুশ্রম থাকবে না, কেউ জোর করে শ্রমে বাধ্য হবে না, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক হবে সৌহার্দ্যপূর্ণ।
ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের মাস্টার্স ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান সাজু বলেন, শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সকল শ্রমিক ভাইদের প্রতি শুভেচ্ছা জানাই। আমি নিজেও একজন শ্রমিকের সন্তান। আমি মনে করি, সভ্যতা নামক জাহাজ শ্রমিকের ঘামের উপর দিয়েই চলে। লক্ষ্যণীয় যে, গত জুলাই বিপ্লবের সময় তথাকথিত সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের আগেই রিকশাওয়ালা, দিনমজুররা রাস্তায় নেমেছিল; তরুণদের প্রতি আস্থা রেখেছিল।
তারুণ্যের এই নতুন বাংলাদেশে আমরা এমন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই, যেখানে শ্রমিকের মান-মর্যাদা ও ন্যায্য মজুরি সংরক্ষিত থাকবে।