Logo
শিরোনাম

রক্তের অক্ষরে লেখা ১৫ আগস্ট আজ

প্রকাশিত:সোমবার ১৫ আগস্ট ২০২২ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ মে ২০২৪ |

Image

মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, গবেষক :

আজ বাঙালির শোকের দিন। বাঙালির জনক হারানোর কান্নার দিন। জাতির ইতিহাসে কলঙ্কেরও দিন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সন্তানসম বিপথগামী কিছু বাঙালির হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুষ্কৃতকারীরা জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু বাঙালি জাতিকেই কলঙ্কিত করেনি, রুদ্ধ করে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে। বিশ্বদরবারে বাঙালি জাতির মাথা নুইয়ে দিয়েছিল সেই পৈশাচিক ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির মহানায়কস্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে তখন ক্ষতবিক্ষত অবস্থা থেকে দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত ছিলেন। তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা।

এ এক ভয়ঙ্কর বীভৎসতা! পুরো বাড়িটি যেন রক্তগঙ্গা। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু, বুক যার বাংলাদেশের হৃদয়। নিথর দেহের পাশেই পড়ে রয়েছে ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপ। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল যে মায়ের কাছে যাবে বলে বায়না ধরেছিল।

রক্তের অক্ষরে লেখা ১৫ আগস্ট আজ। জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। এই কালো দিনটিতেই জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, আবহমান বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রক্তঝরা এই দিনটিতে ঘৃণ্যতম একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হয়েছিলেন বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল রক্তাশ্রু

 হতবিহ্বল জাতির চারদিকে ছিল ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন। মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ। ভয়ার্ত বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস। সেই শোক অনির্বাণ এখনো বাংলায়। নদীর স্রোতের মতো চির বহমান কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।

সময়ের পরিক্রমায় পিতা হারানোর বেদনায় ব্যথাতুর বাঙালির কান্নার দিন আজ। অসংখ্য কবির কবিতা, শিল্পীর আগুনঝরা গীত, সাহিত্যিকের ক্ষুরধার লেখনী আর স্বাধীনতাপ্রিয় কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুরকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করার দিন। মর্মস্পর্শী এই দিনটি আজ জাতীয় শোক দিবস।

অভিশপ্ত এই দিনটিতে বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দীর্ঘ ৩৪ বছরেরও বেশি সময় পর সেই কলঙ্ক থেকে জাতির দায়মুক্তি ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জাতির জনক হত্যা, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলের ঘৃণ্য ও তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালির বিজয়ের অভিযাত্রাও আরেক ধাপ এগিয়েছে। যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান/ ততদিন তোমার কীর্তি রবে শেখ মুজিবুর রহমান’- অমর এই কবিতার মতোই অনন্তকাল বাঙালি জীবনে, ইতিহাস-ঐতিহ্যে আর বিশ্বের শোষিত প্রাণের লড়াই সংগ্রামে চিরভাস্বর হয়ে আলোর পথ দেখাবেন টুঙ্গিপাড়ার রাখাল রাজা খোকা।

যে রাতে খুলে গিয়েছিল নরকের দরজা : সেই রাতে আকাশে একটিও নক্ষত্র ছিল না, সেই প্রাতে সূর্যালোক বন্দি ছিল কৃষ্ণ গহ্বরেসেই রাতে ঈশ্বর তাই দেখতে পাননি, পৃথিবীতে কী ঘটেছিল!১৫ আগস্ট চ্যান্সেলর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে আটটার দিকে গণভবন থেকে বাড়ি ফেরেন। ওই রাতে কাওরান বাজারে একটি ট্যাংক, পিজি হাসপাতালের সামনে আরেকটি ট্যাংক, মতিঝিলের কাছে আরো একটি ট্যাংক দেখতে পান রাজধানীবাসী। এক কিলোমিটারের ব্যবধানে ৩টি ট্যাংক, আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সামনে আরেকটি ট্যাংক দেখেও কারো মনে কোনো প্রশ্ন আসেনি।

কৃষ্ণপক্ষের ওই অন্ধকার রাতে খন্দকার মোশতাকের ৫৪ নং আগামাসি লেনের বাসায় মেজর রশিদ এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের একান্ত বৈঠক হয়। পরদিন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা জানানো হবে বলে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কাজ করে সেদিন মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন মুজিবপুত্র কামাল।

১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বেরিয়ে আসে বর্বরোচিত ঘটনার নৃশংস চিত্র। শিশুপুত্র রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ঘুমাচ্ছিলেন দোতলায়। শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল তিনতলায়, শেখ জামাল ও রোজী জামাল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন দোতলায়। ঘুমাচ্ছিল বাংলাদেশ। শুধু জেগেছিল চক্রান্তকারীরা। ঘাতক এজিদ, সীমার আর দুর্যোধনের অট্টহাসিতে বিদীর্ণ হয় রাত্রির নিস্তব্ধতা। পৈশাচিক উল্লাসে আবারো খণ্ড-বিখণ্ডিত হয় রক্তে কেনা বাংলাদেশ।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, অপারেশন ১৫ আগস্টের নেতৃত্বে ছিল কর্নেল ফারুক। তারই পরিকল্পনায় ৭৫ থেকে ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানো হয়। তিনটি দলের প্রধান টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ি। শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণের জন্য প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হয় বহিষ্কৃৃত সেনা কর্মকর্তা মেজর ডালিমকে। রাষ্ট্রপতি পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের কারণে হয়ত বা ডালিম বঙ্গবন্ধুর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালাতে ব্যক্তিগতভাবে নারাজি দেখায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করার পরিবর্তে সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয় ডালিম। আর জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ঘটনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মহিউদ্দিনকে। তাদের সঙ্গে ছিল এক কোম্পানি ল্যান্সার।

খুনি ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে দেয়া হয় শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের। খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল সবাইকে হত্যা করার। এ ছাড়া খুনিদের পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা পরবর্তীতে খুনিদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন যে কাউকেই প্রয়োজনবোধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কর্নেল ফারুক। খুনি গ্রুপ ছাড়াও হত্যাকাণ্ডের বাধা আসতে পারে এমন স্থানেও কিছু সৈন্য মোতায়েন ও ট্যাংক প্রস্তুত করে রাখে হায়েনারা। যেন কেউ প্রতিহত করতে আসার আগেই পৃথিবী থেকে চিরতরে তাকে সরিয়ে দেয়া যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটা ট্যাংক বিমানবন্দরের রানওয়ে আটকাবে আর সৈন্যরা মিরপুর ব্রিজ নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য দলগুলোকে পাঠানো হবে রেডিও স্টেশন, বঙ্গভবন আর নিউমার্কেটের পাশে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বিজিবি-বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) সদর দপ্তরে। আর ঢাকা সেনানিবাসে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ব্যস্ত কর্নেল ফারুক বেঙ্গল ল্যান্সারের উদ্দেশ্য ভাষণে ধর্মের দোহাই দিয়ে মুজিবকে শেষ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। খুনি ফারুক বলে, ‘যদি তোমরা ব্যর্থ হও, তাহলে মুজিব সেনাবাহিনীদের শেষ করে দেবে এবং ল্যান্সারদের বাতিল করবে। অতএব আর দেরি নয়। এবার আঘাত হানার সময় এসেছে।

ভোর ৪টা ০৮ মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে যায় খুনিবাহিনী। রক্তপিপাসু ঘাতক চক্র তিন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাত্র দুই কিলোমিটার দূরেই তাদের লক্ষ্যবস্তু। গভীর রাতে রক্ষীবাহিনী তড়িঘড়ি করে শেরেবাংলা নগরের এমএনএ-এর হোস্টেলের সামনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে অবস্থান নিলেও অজ্ঞাত

কারণবশত কিছুক্ষণ বাদেই ফেরত যায় (কার নির্দেশনায় ফিরে যায়, এ প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি)। একটি ট্যাংক পুরনো এয়ারপোর্টের রানওয়ে দিয়ে এসে একটি দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে ট্যাংকের বন্দুকের নলটি তাক করে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। মুজিব ও তার ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ট্যাংক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। মূল দলটি ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ভোর ৫টার মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি এবং তার আশপাশের এলাকা। ১২টি ট্রাক ও কয়েকটি জিপে করে আক্রমণকারী ল্যান্সার ও আর্টিলারির প্রায় ৫০০ জন রাইফেলস ট্রুপস আশপাশে ছেয়ে যায়। খুনি মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূরের নেতৃত্বে আউটার ও ইনার দুটি বৃত্তে ঘেরাও করে ফেলে ওই বাড়িটি।

আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পুলিশ গার্ডরা অবিরাম গুলি চালিয়ে সেনাদের আক্রমণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। আর্টিলারির শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা যান। আরো একজন আহত হন। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বঙ্গবন্ধু ভবনের ভেতর থেকে প্রচণ্ড প্রতিরোধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলি করতে থাকে চারদিক থেকে। একটি বুলেট মুজিবের ছোটভাই নাসেরের হাতে লাগে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের মতো এবারো বাড়ির সবাই শেখ মুজিবের শোবার ঘরে আশ্রয় নেন। শেখ মুজিব কয়েকজন অফিসারকে ফোন করেন এবং বারান্দায় এসে পুলিশদের ফায়ার বন্ধ করতে বলেন। বেগম মুজিব শাড়ির এক অংশ ছিড়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন নাসেরের রক্তাক্ত হাতে।

 কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে এসে গার্ডদের অবস্থান নেয়ার জন্য বলেন; কিন্তু ততক্ষণে গার্ডরা নিরস্ত্র। এই মুহূর্তে মেজর হুদা কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে গার্ডরা হুদাকে স্যালুট দেয়। এতে আক্রমণকারী সৈন্যরা বিনা বাধায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশের সহজ সুযোগ পেয়ে যায়। ঢুকেই তারা নিচতলার প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করে এবং মেজর হুদার সঙ্গে থাকা একজন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে কামালকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। শেখ কামাল ও শেখ জামাল সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই শুরু করেন। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি কামাল। ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে সিঁড়ির সামনে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

বঙ্গবন্ধু যখন গোলাগুলির মধ্যে আক্রান্ত ছিলেন, তখন তিনি বাসা থেকে বিভিন্ন দিকে ফোন করে সাহায্য চাইলেন। তিনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ ফোন ধরছিল না। এরপর ফোনটি করেন তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে। যাকে মাত্র ১৫ দিন আগে শেখ মুজিব বিশেষভাবে নির্বাচন করেছিলেন। তাকে বলেন, ‘জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আস। আর্মির লোক আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো। জামিল ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে আসেন শেখ মুজিবকে বাঁচাতে। পোশাক পরিধানের সময় না পেয়ে পাজামার ওপর ড্রেসিং গাউনটি চড়িয়ে তার প্রাইভেট লাল কার হাঁকিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থল ৩২ নম্বরে, কিন্তু ততক্ষণে ৩২ নম্বর সড়কের ৬৬৭ নম্বর বাড়িটি কারবালার ময়দান। জামিল গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকতে চাইলে, সৈন্যরা গুলি চালায় জামিলের বুকে আর মাথায়। টলতে টলতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনেই মৃত্যুর হিমশীতল পরশ আলিঙ্গন করে নেন তিনি। নিজের জীবনের বিনিময়েও শেখ মুজিবের কোনো কাজে আসতে পারলেন না মুজিব সেনা জামিল।

একসময় সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হয় বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার আর্মি আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।সফিউল্লাহ বলেন, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস। এরপর সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান।

 তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। এর মধ্যেই বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মেজর মহিউদ্দিন, হুদা, নূর চৌধুরীসহ ঘাতকের দল। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গোড়াতেই দেখা হয়ে যায় ঘাতকের কিলিং মিশনের প্রধান টার্গেট জাতির জনক সঙ্গে। ধূসর রঙের চেক লুঙ্গি-সাদা পাঞ্জাবি আর ডানহাতে প্রিয় পাইপের চিরায়ত বাঙালির শ্বাশত রূপের প্রতিকৃতি বিশাল হৃদয়ের শেখ মুজিবের সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে বিচলিত হয়ে যায় খুনি মহিউদ্দিন। শেখ মুজিবকে হত্যার দৃঢ় মনোবল নিয়ে আসা মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে বলে, স্যার আপনি আসুন। অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় গর্জে ওঠে সিংহ হৃদয়, ‘তোরা কী চাস? কেন বেয়াদবি করছিস? তোরা কি আমাকে খুন করতে চাস ? ভুলে যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তা পারেনি। তোমরা কি মনে করো, তা পারবে?’ শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকেই যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘যে দেশের সেনাবাহিনী সদস্যরা, দেশের ও সেনাবাহিনীর আইনশৃঙ্খলা ও সংবিধান লঙ্ঘন করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বাসা আক্রমণ করতে পারে, আমি তার রাষ্ট্রপতি থাকতে চাই না। তবে তোমাদের মতো অধঃস্তন কর্মকর্তাদের কাছে পদত্যাগও করতে পারি না। তোমাদের সেনাবাহিনীর চিফ ও ডেপুটি চিফদের এখানে নিয়ে এসো, তাদের কাছে ইস্তফাপত্র দেব।এ সময় দুজন মেজর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার জন্য বললে বঙ্গবন্ধু আবারো বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে শেখ কামালকে যেতে দিলে আমি বেতার কেন্দ্রে যেতে পারি। পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বের কাছে নিতান্তই বেমানান খুনি তখনো একই গান গেয়ে যাচ্ছিল, স্যার, আপনি আসুন। আর অন্যদিকে থামছিল না মুজিবের ধমকানো। কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পড়ে যায় ল্যান্সার মহিউদ্দিনের পিস্তল। এমন সময় স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান নিয়ে দৌড়ে আসে ঘাতক নূর চৌধুরী। 

শেখ মুজিব ধমকিয়ে তাদের সময় ও মনোবল নষ্ট করতে চাইছেন বুঝে ফেলে নূর চৌধুরী। মহিউদ্দিনকে ধাক্কা মেরে এক পাশে সরিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘স্টপ! দিস বাস্ট্রার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ। গর্জে ওঠে স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান। বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ছয় ফুট দুই ইঞ্চির বিশাল দেহ মুখ-থুবড়ে পড়ল সিঁড়িতে। বুকের ডানদিকে গুলির বিরাট ছিদ্র। যে উঁচু করা তর্জনী ছিল পাকিস্তানের ভয়ের কারণ আর সন্তানসম বাঙালির আস্থার প্রতীক, ঘাতকের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় সেই তর্জনীটি। তবুও ডানহাতে আঁকড়েধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ।

মসজিদের শহর খ্যাত ঢাকার মসজিদ থেকে ভেসে আসা পবিত্র আজানের ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ঘাতকদের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। বিদীর্ণ করে বাংলাদেশের বুক। শহিদ হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার এক অপূর্ণ মহৎ স্বপ্ন। ভোরের সময়ই অস্তমিত হয়ে যায় জাতীয় গৌরবের প্রতীক সূর্যের মতো একটি অনন্য অধ্যায়। অন্ধকারের কালো মেঘে ঢেকে যায় বাংলার আকাশ। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে অন্ধকার এক সাম্প্রদায়িকতার চোরাগলিতে।

নির্মম রাতে প্রাণ দিয়েছেন যারা : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান তার প্রিয় সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। প্রবাসে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই রাতে আরো প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমকর্তা ও কর্মচারী। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে এই শহিদদেরও।

মহাকালের মহানায়ক : ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত মহাকাব্যের মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক হিসেবে। এ মহাকাব্যের আবেদন কোনোদিন শেষ হবে না। উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে জাতিকে অনুপ্রেরণা দেবেন। গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা, নিপীড়িত জাতির স্বাধিকার অর্জন এবং মুক্তিসংগ্রামের অবিনাশী গান শোনাবে তার অমর কবিতা ৭ মার্চের ভাষণ। সেই সঙ্গে বাঙালি জাতি পাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অবিনাশী প্রেরণা। মৃত্যুর পরও তার মহাকর্ম যুগ যুগ এদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

 


আরও খবর



গরমে কাঁচা আম খাওয়ার উপকারিতা

প্রকাশিত:মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ মে ২০২৪ |

Image

আম ফল সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় এত পছন্দনীয় ফল পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এমন কোন জাতি নেই যারা আম পছন্দ করেনা। তাই একে সন্মান দিয়ে ʼফলের রাজাʼ বলা হয়। এই গরমে কাঁচা আম সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারগুলোর মধ্যে একটি।

কাঁচা আমে অগণিত প্রয়োজনীয় ভিটামিন যেমন ভিটামিন সি, কে, এ, বি৬ থাকে। এতে থাকা ফোলেট বিভিন্ন রোগের নিরাময়ে উপকারিতা দেয়। পরিপাকজনিত সমস্যা দূর, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি এবং ওজন কমানোর জন্য কাঁচা আম নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে। এর আরও কিছু উপকারিতা সম্পর্কে চলুন জেনে নেওয়া যাক-

গরমে প্রশান্তি দেয়

ওয়ার্কআউট করার পর এক গ্লাস কাঁচা আমের জুস একটি দারুণ সতেজ পানীয় হিসেবে কাজ করে। এটি উত্তপ্ত তাপের প্রভাব কমিয়ে দেয়। এই পানীয় শরীরে সোডিয়াম ও অন্যান্য খনিজের ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করে ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে। যেহেতু গরমের সময়ে ঘামের কারণে প্রয়োজনীয় খনিজের ক্ষয় হয়, তাই কাঁচা আম শরীর ঠান্ডা রাখতে একটি আদর্শ খাবার হিসেবে কাজ করে।

হজমের সমস্যায় উপকারী

গরমের সময় বেড়ে যাওয়া গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যার চিকিৎসার জন্য কাঁচা আম বেশ ভালো কাজ করে। এটি পাচন রসের নিঃসরণকে উদ্দীপিত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম, অম্লতা, অম্বল, মর্নিং সিকনেস এবং বমি বমি ভাবের চিকিৎসা করে পরিপাকতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।

হার্ট সুস্থ রাখে

কাঁচা আমে থাকা প্রয়োজনীয় বি ভিটামিন নিয়াসিন এবং ফাইবারের সমৃদ্ধি হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধ করে।

লিভার ভালো রাখে

কাঁচা আম লিভারের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এবং এর রোগের চিকিৎসার জন্য দুর্দান্ত। এটি পিত্ত অ্যাসিডের নিঃসরণকে উদ্দীপিত করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলোকে পরিষ্কার করে ফ্যাট শোষণ বাড়ায়।

দাঁতের জন্য উপকারী

কাঁচা আম একটি শক্তিশালী ফল যা নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ দূর করে, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা করে এবং এটি দাঁতের গহ্বরের ঝুঁকি কমায়। শক্ত ও পরিষ্কার দাঁত পেতে চাইলে কাঁচা আম খাওয়া শুরু করুন।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

কাঁচা আমে থাকা ভিটামিন সি, এ এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে, ত্বক ও চুলকে সুস্থ করে তোলে এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এটি শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ যেমন সাধারণ সর্দি, কাশি ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে।

রক্তের ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করে

বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ দেখিয়েছে যে কাঁচা আম খেলে তা রক্তস্বল্পতা, রক্ত জমাট বাঁধা, হিমোফিলিয়ার মতো রক্তের ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কাঁচা আম কোলাজেন সংশ্লেষণ বৃদ্ধি করে, রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং নতুন রক্তকণিকা তৈরিতেও সাহায্য করে।

ক্ষতিকর দিক

পরিমিত পরিমাণে কাঁচা আম বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপকারী। তবে বেশি পরিমাণে কাঁচা আম খেলে বদহজম, পেটে ব্যথা, আমাশয় এবং গলা জ্বালা হতে পারে। মনে রাখবেন, কাঁচা আম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানি পান করবেন না কারণ এটি জ্বালা বাড়ায়।


আরও খবর

বিভিন্ন দেশে ঈদের জনপ্রিয় খাবার

শুক্রবার ০৫ এপ্রিল ২০২৪




মে মাসেই আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড়

প্রকাশিত:সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ মে ২০২৪ |

Image

তাপপ্রবাহ শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কার কথা বলছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী ১০ দিনের মধ্যে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা নেই বললেও মে মাসের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ  বলেছেন, দেশে চলমান তাপপ্রবাহ মে মাসের ২ তারিখের আগে কমার সম্ভাবনা খুবই কম। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে মে মাসের ১৫ তারিখের পরে। ঘূর্ণিঝড় যদি বাস্তবে সৃষ্টি হয় তবে সেটির নাম হবে রিমাল। এই নামটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের দেওয়া।

তিনি মার্কিন আবহাওয়া পূর্বাভাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, বর্ষার পূর্বে ঘূর্ণিঝড় মৌসুম মার্চ মাসে শুরু হলেও ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে কোন ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ কিংবা লঘুচাপও সৃষ্টি হয়নি। তাই বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি যেহেতু মে মাসের ১৫ তারিখের পরে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা সেহেতু সেটি খুবই শক্তিশালী হওয়ার আশঙ্কা আছে।

মে মাসের ৩ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির শক্তি কেমন হবে ও কোন উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি সে সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন মোস্তফা কামাল পলাশ।

তিনি বলেন, আগামী মাসের ১৩ থেকে ১৪ তারিখের দিকে নিম্নচাপটি সৃষ্টি হতে পারে। এটি পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিলে ২০ থেকে ২৪ মে এর মধ্যে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। ঘূণিঝড়টি সৃষ্টি হলে এটি অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহানাজ সুলতানা বলেন, আগামী ১০ দিনের পূর্বাভাসে কোনো ঘূর্নিঝড়ের সম্ভাবনা নেই। তবে বর্ষা পূর্ববর্তী সময়ে সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি থাকে। সে হিসেবে মে মাসের শেষের দিকে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে রবিবার (২৮ এপ্রিল) দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুইদিন পর চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। শনিবার (২৭ এপ্রিল) এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীতে গতকাল তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। একই দিনে ঢাকায় তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সন্ধ্যার বুলেটিনে গতকাল বলা হয়েছে, সারাদেশে সর্বোচ্চ ১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। সিলেটে ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়নি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ বিচ্ছিন্ন বৃষ্টি বা বজ্রঝড়ের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক জানিয়েছেন, সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আর্দ্রতা বৃদ্ধির কারণে অস্বস্তি অব্যাহত থাকতে পারে। এখনো সারা দেশে বৃষ্টি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী ৩০ এপ্রিল (মঙ্গলবার) পর্যন্ত তাপ সতর্কতা বাড়িয়েছে কারণ চলমান তাপপ্রবাহ গতকাল থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। এই মাসে এটি ৭ম তাপপ্রবাহ সতর্কতা।


আরও খবর



মা দিবসে মেয়ের আকিকা দেবেন পরীমণি

প্রকাশিত:শুক্রবার ১০ মে ২০২৪ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ মে ২০২৪ |

Image

ছয়দিন বয়সী ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানকে দত্তক নিয়েছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের লাস্যময়ী অভিনেত্রী পরীমণি। ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজারে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন চিত্রনায়িকা পরীমণি। এতে তিনি জানিয়েছেন, ছেলে পুণ্যের পর এবার মেয়ের মা হয়েছেন তিনি। ৬ দিনের ওই শিশুকে দত্তক নিয়েছেন নায়িকা।

কন্যার নাম রেখেছেন সাফিরা সুলতানা প্রিয়ম। ১২ মে মা দিবসে কন্যার জন্য বিশেষ এক আয়োজন করতে যাচ্ছেন নায়িকা। সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিজেই জানিয়েছেন পরীমণি।

বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, এক অন্যরকম অনুভূতি। ছেলের পরে মেয়ে! কী যে আনন্দ! আগামী ১২ মে হবে প্রিয়মের আকিকা। মা হিসেবে যতটুকু সুন্দর করা যায় সেভাবেই এটা আমি করব। কন্যার নাম সাফিরা সুলতানা প্রিয়ম।

দত্তক নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আমি ওকে দত্তক নিয়েছি। নিয়ম মেনে সই করার সময় মনে হল আল্লাহ আবার আমার জন্য কিছু করলেন। জীবনে কোনও দিন কিছু নিয়ম অনুযায়ী বা পরিকল্পনা করে করিনি। তাই আল্লাহ আমার জন্য যা যা চেয়েছেন তাই মাথা পেতে নিয়েছি। ও পরীর মতোই আমার কোলে চলে এল। কোলে যখন নিই, মনে হয় আমার নাভি কেটেই ও এসেছে। ওর ছবি এখন দিচ্ছি না। কেউ রাগ করবেন না! মা তো... আর কিছু দিন যাক।

তিনি আরও বলেন, আমি যা মন থেকে চাই তাই করি। কে কী বলল সে সব নিয়ে কোনও দিন ভাবিনি। কে বলেছে বাবা ছাড়া সন্তান মানুষ করা যায় না? কে বলেছে জন্ম দেওয়া বাবা-মা ছাড়া সন্তান মানুষ হয় না? এই সব নিয়ম সমাজের তৈরি। এই তো আর কয়েক দিনের মধ্যেই মাতৃ দিবস নিয়ে হইচই হবে। কিন্তু সেখানেও তো পিতৃতন্ত্রের আদলে তৈরি করা মেয়েদের জয়গান। এ সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে কাজ আর সন্তানদের নিয়ে বাঁচব আমি। এখন রাতের দিকে সব শান্ত হয়ে আসার পরে এক দিকে ছেলে আর এক দিকে ঘুমন্ত মেয়ের মাঝে যখন চোখ খুলে দেখি তখন মনে হয় পরীমণির আকাশটা বড় হয়ে আসছে।

প্রসঙ্গত, হাতে একগুচ্ছ কাজ পরীমণির। ব্যস্ত রয়েছেন টলিউডের একটি ছবি নিয়ে। ফেলু বক্সী নামের একটি ছবিটিতে কাজ করছেন তিনি। সেখানে তার সঙ্গে আছেন সোহম চক্রবর্তী ও মধুমিতা সরকার। এটি নির্মাণ করছেন দেবরাজ সিনহা।


আরও খবর



মুজিবনগর সরকার : মুক্তিযুদ্ধে প্রভাব

প্রকাশিত:বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ মে ২০২৪ |

Image

সোহেল মাজহার: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে মুজিবনগর সরকারের ঐতিহাসিক ভূমিকা অপরিসীম। অর্থাৎ অস্থায়ী প্রবাসী মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কার্যকর ও আইনসঙ্গত নেতৃত্ব প্রদান করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬৬ সালে তার ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপন করেন। ছয় দফা উত্থাপনের কারণে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মুখোমুখি হতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি ও ছয় দফার পক্ষে প্রবল জনমত গঠন হয়। একই ধারাবাহিকতায় ৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি অভিনব ও স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান এবং ২৩ ফেব্রয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র জনতার পক্ষে তোফায়েল আহমেদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭ টি আসন ও প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।

৭১-এর মার্চের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারি ঘটনা হলো রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণে মাত্র ১৭/১৮ মিনিটে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ২৩ বৎসরের শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার নির্মম ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি বাঙালি জাতির গৌরবময় আন্দোলন সংগ্রামের কথা স্মরণ করেন। ভাষণের একটি পর্যায়ে বলেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।

 আরো উল্লেখ করেন, প্রত্যেক পাড়ায়-মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, অমোঘ বাণী উচ্চারণ করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মূলত এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করা ছাড়া অলিখিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সংগঠন, সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণ, সেল্টার ও গেরিলা যুদ্ধ সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক পরিচালনার দিকনির্দেশনা ছিল ৭ মার্চের ভাষণে।

৭ মার্চের ভাষণের আলোকে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত হয় । এই সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে ৩৫ দফা নির্দেশনা ঘোষণা করেন। এদিকে ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে খোদ ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার স্হাপিত হয়। আবার ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী জয়দেবপুরে অবস্থানরত বাঙালি রেজিমেন্টেকে নিরস্ত্র করতে চাইলে মেজর শফিউল্লাহ এর নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তা প্রতিরোধ করে।

এই ঘটনায় মনু মিয়া, হুরমত ও নিয়ামতসহ স্হানীয় চারজন শহিদ হন। অন্যদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কালক্ষেপণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে। প্রাথমিক অবস্হায় একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, আবাসিক ভবন - ডরমিটরি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ই.পি.আর পিলখানায় ব্যাপত গনহত্যা চালায়। এই রাতেই গণহত্যা ঢাকা শহরের বস্তি এলাকা, রাজপথ ও ফুটপাতেও চলে। মোদ্দাকথা এক রাতের মধ্যে ঢাকা শহর মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৩২নং ধানমন্ডি, তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি করতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান।

২৬ মার্চ থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইপিআর, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীসহ স্হানীয় মুক্তিকামী মানুষ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। এ সকল যুদ্ধ ছিল অবিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত , তাৎক্ষণিক এবং অনেক ক্ষেত্রে তা নেতৃত্বহীন-অদূরদর্শী। একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেরণার মূলে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও ৭ মার্চের ভাষণ। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রবল আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তি আছে। আর তা হলো ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জন।

এটিই মুক্তিযুদ্ধকে সমগ্র পৃথিবীতে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা দান করে। পৃথিবীর অনেক দেশের ন্যায্য স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াই শুধুমাত্র নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে অন্তঃ লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে তা দীর্ঘস্হায়ী হয়েছে । আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও আরাকানসহ পৃথিবীতে এরকম অনেক উদাহরণ আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যতটুকু অন্তঃবিরোধ, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ছিল, তা যৎসামান্য। মূলত ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠিত হওয়ার ফলে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালিত হয়।

বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। আওয়ামী লীগের অনেক জাতীয় নেতা আত্মগোপন করেছেন। নেতারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অনেকের কাছেই অনেকের খবর নেই। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হলেও পাকিস্তান বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকছে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিথিল কিংবা নেই। স্হানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনেক এমএনএ ও এমপিএ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ অধিকাংশজন আত্মগোপনে চলে যায়।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এই নেতৃত্বহীনতা ও বঙ্গবন্ধু মুজিবের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভব করেন। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার পর প্রাথমিকভাবে আত্মরক্ষা করে তিনি ঢাকা থেকে গা ঢাকা দেন। ২৭ মার্চ তিনি ঝিনাইদহ উপস্থিত হন৷ তৌফিক এলাহি ও মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রমের প্রমুখের সহায়তায় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত চলে যান। মার্চের ৩০ তারিখ পশ্চিম বাংলা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ২ এপ্রিল তিনি দিল্লিতে যান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন। উভয় নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি রাজনৈতিক সরকারের অভাব অনুভব করেন। তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লি থেকে ফিরে এসে কুষ্টিয়া সীমান্তে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিদের নিয়ে একটি অধিবেশন আয়োজন করেন।

অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ এপ্রিল অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগারে রেখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দিন আহমদ। মন্ত্রিপরিষদের অন্যন্য সদস্যগণ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচএম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অস্হায়ী প্রবাসী সরকার ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার ঐতিহাসিক আম্রকাননে শফথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ, ভারত ও পৃথিবীর আরো কয়েকটি দেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ বাক্য পাঠ করান স্পিকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করেন। শফথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সংক্ষিপ্ত ও তাৎপর্যময় বক্তব্য রাখেন।

তাজউদ্দিন আহমদ তার বক্তব্যে বৈদ্যনাথ তলার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম করেন মুজিবনগর। এই নতুন নামকরণের মধ্য দিয়ে প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার নামে অধিক পরিচিতি পায়। মুজিবনগর সরকারের নামকরণের তাৎপর্য অন্য জায়গায়। এই নামকরণের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও বঙ্গবন্ধু মুজিবই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। তার নেতৃত্বেই অস্থায়ী প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। কার্যত মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিকল্প ছিল না। যে কারণে অনেকে বিশ্বাস করতেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত আছেন এবং তিনি সশরীরে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন।

এর আগে আরো কিছু ঘটনা ঘটে। ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মেজর খালেদ মোশাররফের অস্থায়ী দপ্তরে মিলিত হন। তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সামরিক বিবেচনায় তারা সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে। দায়িত্বগুলো ছিল নিম্নরূপ ১. চট্টগ্রাম অঞ্চল - মেজর জিয়াউর রহমান ২. কুমিল্লা অঞ্চল - মেজর খালেদ মোশাররফ ৩. সিলেট অঞ্চল - কে. এম শফিউল্লাহ ও ৪. যশোর অঞ্চল - মেজর কে.এম আবু ওসমান চৌধুরী। কিন্তু যাই হোক প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে এসব কিছুকে অনুমোদন ও বৈধতা দেওয়ার কেউ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ আইনের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ না হয়ে বিচ্ছিনতাবাদী যুদ্ধে রূপান্তরিত হতো।

যা হোক, প্রবাসী সরকারের দপ্তর স্থাপিত হয় ৮ থিয়েটার রোড কলকাতায়। ইতোমধ্যে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রবাসী সরকার অনুমোদন করে। মুক্তিযুদ্ধকে সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য শফথ গ্রহণের পূর্বেই ১১ এপ্রিল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়।

'ভারতের মাটিতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের রাজনৈতিক সরকারের কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ সরকার কিংবা বৈধ প্রতিনিধি না থাকলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার কার সঙ্গে কথা বলবে, নেগোসিয়েটেড করবে। বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রবাসী মুজিব নগর সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সরকার গঠনের পাশাপাশি প্রশাসন কাঠামো ও সুসংহত আমলাতন্ত্র গঠন করেছিল। ১১ জুলাই সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর সেক্টর গঠনের সমান্তরালে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ ( zonal Council) গঠন করে। ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ ১১ জন করে চেয়ারম্যান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে মূলত মুক্তিবাহিনীর উপর বেসামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

২০ তারিখের মন্ত্রিপরিষদের সভায় সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে কতগুলো মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪. মন্ত্রী পরিষদ সচিবালয় ৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ ৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় ৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়(৯) ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় (১০) সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় (১১) কৃষি বিভাগ (১২) প্রকৌশল বিভাগ। মন্ত্রী পরিষদের কর্তৃত্বে আরও কয়েকটি সংস্থা গঠিত হয়। সংস্থাগুলো হলো ১. পরিকল্পনা কমিশন ২. শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড ৩. নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব অভ্যর্থনা শিবির ৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি ৫. শরনার্থী কল্যাণ বোর্ড। উপরিউক্ত মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্হা সৃষ্টি করা ছাড়াও অগ্রিম পরিকল্পনা প্ল্যানিং সেল, গণহত্যা সেল ও উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। বিশেষত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য প্রতিনিধিদল প্রেরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এভাবেই সোভিয়েত ব্লক সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ব্যক্ত করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ানোর পিছনে প্রবাসী সরকারের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়।

ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর জন্য ট্রেনিং সেন্টার স্হাপন, অস্ত্র-রশদ সরবরাহ ও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান, ভারতের মাটিতে প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার পেছনে অস্থায়ী সরকারের ভূমিকা ছিল। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন, ৬ ডিসেম্বর ভুটানের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, ৭ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতি প্রদান প্রবাসী সরকারের বড় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য। সবচেয়ে বড়ো কথা বাংলাদেশের ১১ টি সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনী প্রবাসী সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছিল। প্রবাসী সরকারের অনুমোদন ছাড়া তা মুক্তিযুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃত হতে পারে না। মুক্তিবাহিনী সরকারের অনেকগুলো বিভাগের মধ্যে একটি বিভাগ। অবশ্য এটিই ছিল সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বা অঙ্গ। কাজেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।

লেখক : অধ্যাপক, কবি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক। ইমেইল : [email protected]


আরও খবর

ভালো থাকুক পৃথিবীর সব মা

রবিবার ১২ মে ২০২৪




গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর

প্রকাশিত:শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | হালনাগাদ:সোমবার ১৩ মে ২০২৪ |

Image

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় সাত মাস ধরে চলা ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অবিস্ফোরিত গোলাবারুদসহ বিপুল পরিমাণ ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করতে প্রায় ১৪ বছর সময় লাগতে পারে। শুক্রবার জাতিসংঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিসের (ইউএনএমএএস) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পেহর লোধাম্মার এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।

গাজার ক্ষমতাসীন ইসলামি শাসক গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ২৩ লাখ মানুষের সংকীর্ণ ও উপকূলীয় অঞ্চলটিকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। বর্তমানে সেখানকার বেশিরভাগ বেসামরিক মানুষ গৃহহীন, ক্ষুধার্ত এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

জেনেভায় এক ব্রিফিংয়ে পেহর লোধাম্মার বলেছেন, যুদ্ধের ফলে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণ ওই অঞ্চলে পড়ে আছে।

তিনি বলেন, গাজায় পাওয়া অবিস্ফোরিত গোলাবারুদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। তারপরও ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষসহ পুরো ধ্বংসস্তূপ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পরিষ্কার করতে ১৪ বছরের মতো সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেছেন, ‌‌‘‘আমরা জানি, সাধারণত স্থল বাহিনীর ছোড়া গোলাবারুদের অন্তত ১০ শতাংশ অবিস্ফোরিত ও বিকল অবস্থায় থেকে যায়। আমরা ১০০টি ট্রাক ব্যবহার করে ১৪ বছর ধরে পরিষ্কার কাজ চালানোর কথা বলছি।’’

গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাসের শত শত যোদ্ধা গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে ঢুকে এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা ও আরও ২৫৩ জনকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখে। গাজায় হামাসের হাতে এখনও ১২৯ জন জিম্মি রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

হামাসের হামলার জবাবে ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; যাদের মধ্যে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু।

সূত্র: রয়টার্স


আরও খবর