অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী শিক্ষাবিদ :
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন শিক্ষক হওয়া, তারচেয়েও কঠিন ছাত্র হওয়া | পৃথিবীর সব মানুষ আমার শিক্ষক, আমি তাদের ছাত্র-এর চেয়ে সুখের কিছু আর হতে পারেনা | প্রতিদিন মানুষের কাছে শিখছি, সেটা ভালো বা মন্দ দুটোই হতে পারে | তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে বইয়ে যা লেখা আছে সেটাই জেনেছি, বইয়ের বাইরেও যে শেখার একটা বিরাট পৃথিবী আছে তেমনটা কখনো শিখতে পারিনি, জানতেও পারিনি |
যদিও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো ছাত্রদের কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে শেখানো, বইয়ের ভিতরের লেখা অক্ষরগুলো ক্রমাগত গবেষণার বস্তুতে পরিণত হয়ে পরিবর্তন হতে হতে কোন জায়গাটাতে এসে পৌঁছেছে সেটা জানানো, কোন কোন জায়গায় চ্যালেঞ্জ তৈরী হয়েছে সেটা বুঝানো, এই বিষয়গুলো নিয়ে ছাত্রদের চিন্তার জগৎটাকে একটু হালকা বাতাসের মতো নাড়া দেওয়া | সেটা টেনশন দিয়ে দুঃশ্চিন্তা তৈরী করা না, বরং ছাত্রদের চিন্তার গভীরে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে তাদের মধ্যে এমন একধরণের আনন্দের অতৃপ্তি জন্মানো, যেটা খুঁজতে খুঁজতে ছাত্ররা এমন নতুন কিছু বের করে আনবে যা পৃথিবীর চিরায়ত ধারণাকেই পাল্টে দিবে |
শিক্ষায় চিন্তার চর্চার চেয়ে মুখস্থবিদ্যার চিন্তা প্রাধান্য পেলে সেই শিক্ষার মূল্যইবা কতটুকু | চোখে দেখলেই তো মন ভরবেনা, শিক্ষায় যতটা চোখের ক্ষুধা মেটানোর লোভ আছে, ততটাই মনের খোরাক মেটানোর অভাব আছে | অথচ কপালের নিচের চোখের চেয়ে অদৃশ্য মনের দাম অনেক বেশি | যা মানুষ চোখে দেখে সেটা যত না মূল্যবান, তারচেয়েও বেশি মূল্যবান মানুষ যেটা চোখে দেখেনা |
দৃশ্যমান চিন্তার চেয়ে অদৃশ্যমান চিন্তার শক্তি অনেক বেশি | এটা কোনো মনস্তত্ব বা দর্শনতত্ত্ব নয়, এটা সহজতত্ত্ব, সরলতত্ত্ব | ফুলের সৌন্দর্য সবাই দেখতে পায়, ফুলের গন্ধ কেউ চোখ দিয়ে দেখতে পায়না | অথচ গন্ধ ছাড়া ফুল মূল্যহীন | ফুলের গন্ধ না দেখতে পেলেও মানুষ ফুলের গন্ধের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে | যেটা অনভুতি মানুষের মধ্যে গড়ে দেয় | মন না থাকলে অনুভূতি থাকেনা | শিক্ষায় তাই যন্ত্র তৈরী না করে মন তৈরীকে গুরুত্ব দিতে হবে |
তবে প্রকৃতির কাছ থেকে শিখছি, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শিখছি, ক্লাসরুমে বসে থাকা ৬০ থেকে ১২০ জন শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে করতে শিখছি | যদিও এই ৬০ থেকে ১২০ জন কারো কারো কাছে হয়তো ছাত্রের চেয়ে বেশি কিছু নয় কিন্তু আমার কাছে তারা মহান শিক্ষক, আগামীদিনের পৃথিবী বদলানোর মহানায়ক | সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আমি সারাজীবন ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাই, ওরা বছর গড়িয়ে একসময় আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তবে যাবার আগে আবার নতুন নতুন সম্ভাবনাময় শিক্ষকদের তাদের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে যায় | এই ধারা অব্যাহত থাকে, আমার সাথে পরিচয় ঘটে নতুন নতুন শিক্ষকদের | এই জায়গাটাই আমার জন্য গর্বের, আনন্দের, অনুভূতির |
সত্যি কথা বলতে কি, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি, নামগুলোই বদলেছে, জায়গাগুলো বদলেছে, একটার পর একটা বছর পেরিয়ে ক্যালেন্ডারে সময়গুলো বদলেছে, বয়সও বদলেছে, উঁচু উঁচু ডিগ্রি নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বেকার বদলেছে কিন্তু যেটা সেখান থেকে পাওয়ার কথা ছিল সেটা সেখান থেকে পাওয়া হয়নি |
আমি প্রথমেই বলেছি শিক্ষক হওয়া যতটা কঠিন, ছাত্র হওয়া তার থেকেও বেশি কঠিন | আমি জানি পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা ছাত্র আমি | সারা পৃথিবীর ছাত্রদের রাংকিং করা হলে আমার অবস্থান হয়তো সবার পিছনেই হবে | তারপরও ভেঙে পড়িনি, হাল ছেড়ে দেয়নি, শেখার চেষ্টা করতে তো কোনো পাপ নেই, অপরাধ নেই, আর পৃথিবীতে বোকারাই চেষ্টা করে | সে শেখার চেষ্টাটা হয়তো চলবে আমৃত্যু, গন্তব্যে কখনো পৌঁছাতে পারবো কিনা জানিনা |