অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ঃ
বাস্তবতাগুলো খুব কঠিন হয় | মানুষকে অসহায় করে, নিজের চোখের সামনে নিজের বিবেককে পুড়তে দেখে মানুষ | কিন্তু করার তো কিছুই থাকেনা | একদিন যত পথ তৈরী করেছিল সে, সে পথগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে মানুষকে পাথর বানিয়ে দেয় | আত্মসমর্পণ করে মানুষ তার অসহায়ত্বের কাছে | চোখ যত কাঁদে, মন তার থেকে অনেক বেশি কাঁদে | চোখের কান্নায় পানি থাকে, মনের কান্নায় আগুন থাকে | পরিস্থিতি মানুষকে কোনদিকে টেনে নিয়ে যাবে তা কেউ জানেনা | অনিশ্চয়তটা প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনের সাথে ছায়ার মতো চলছে অথচ অনুকূল অবস্থার সাথে থাকতে থাকতে মানুষ ভুলে যায় অনিশ্চয়তাকেই |
মানুষ বইপত্র, গবেষণা, পরীক্ষার খাতায় অনিশ্চয়তার তত্ত্বকে সীমাবদ্ধ রেখে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চায়, সেটার বাস্তব ফলাফলকে কখনো তার জীবনের সাথে যাচাই করে দেখবার মতো সাহস দেখাতে পারেনা | অদ্ভুত বিষয় হলো নিশ্চয়তা একটা নাটকের গল্পের মতো, অনিশ্চয়তা সেই গল্পের অসমাপ্ত উপসংহারের মতো |
আমেরিকান লেখক ফ্রেডরিক ব্রাউন "নক" নামের একটা ফ্ল্যাশ ফিকশন লিখেছিলেন | খুব ছোট একটা গল্প, ছোটর চেয়েও ছোট, তার চেয়েও ছোট | অনেকটা আধুনিক গবেষণার ন্যানোপার্টিকেলের মতো | গল্পটা এমনই যার সূত্রপাত হয়তো আছে, টান টান উত্তেজনা আছে, শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাবার মতো শিহরণ আছে, সমাপ্তি নেই | যার সমাপ্তি থাকেনা, তা নিয়ে মানুষের ভিতরে একধরণের রোমাঞ্চ থাকে, সে রোমাঞ্চ থেকে রহস্যের জন্ম হয় |
যেখানে রহস্য থাকে সেখানে চিন্তার বৈচিত্র্য থাকে | তারপরও ফ্রেডরিক ব্রাউনের শেষটা কেমন হতো তা মিলিয়ে নিতে না পারার একধরণের অনিশ্চয়তাও মানুষের মধ্যে থাকে | একটা অতৃপ্তি মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় যেমন মানুষ তাড়িয়ে বেড়ায় গল্পটার শেষটা নিয়ে তার নিজের চিন্তাকে | চিন্তাও তাহলে দৌঁড়ায়, যেমন পৃথিবীটাও সূর্যের চারিদিকে দৌঁড়ায় |
ফ্রেডরিক ব্রাউনের ক্ষুদ্রতম গল্পটি হলো এমন : “The last man on Earth sat alone in a room. There was a knock on the door…”
যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে : পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটি একাকী একটা রুমে বসে আছেন। হঠাৎ কে যেন তার দরজায় নক করল...।
অনেকভাবে এই গল্পটিকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যে কারণে জীবনের পরীক্ষায় কখনো কখনো মানুষ ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকগুলো জানালাকে খুলতে পারে। মানুষ জীবনের পরীক্ষার লড়তে গিয়ে অনেকগুলো দুর্বোধ্য আবেগকে হাতুড়ি বানিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে। জীবনের পরীক্ষা যেখানে মানুষকে থামিয়ে দেয়, কঠিন ধাক্কা দিয়ে দাবিয়ে দেয়, সেখান থেকে জেগে উঠার অমিত শক্তিটা মানুষকে অনেকটা পথ ধরে টেনে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরীক্ষার খাতার মতো জীবনের খাতায় কল্পনা দিয়ে গল্পটা মানুষকে তার মতো করে লিখতে শেখায়।
যদি গল্পটা এমন হয়: সারা পৃথিবী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মৃত্যুপুরীর মধ্যে বেঁচে আছে মাত্র একজন। দুঃসহ শুন্যতার দহন জ্বালা বুকে নিয়ে একটা অন্ধকার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে আছে সে। সে পুরুষ বা নারী যে কেউ হতে পারে। পৃথিবী কি তবে থেমে যাবে। জীবনের পরীক্ষাগুলো তবে কি আর কারো দেওয়া হবেনা। এমন একটা সময়ে দরজায় একটা ঠক ঠক আওয়াজ, পিনপতন নীরবতার অচলায়তন ভেঙে হতচকিত চোখ।
ঘরের ভিতরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে যে, হয়তো তার বিপরীত লিঙ্গের কেউ হবে। কেউ তারা কাউকের চেনা জানেনা। তবে জীবনের পরীক্ষা তাদের খুব কাছাকাছি টেনে আনে। যাদের সম্পর্কের বন্ধনে জন্ম নিবে মানুষ। মানুষের পর মানুষ। মানুষের ভিতরে মানুষ। পৃথিবী মরে যাওয়া জনপদের জীবনের পরীক্ষায় সফল হয়ে আবার গড়ে তুলবে সভ্যতা। সভ্যতার পর সভ্যতা। সভ্যতার ভিতরে সভ্যতা |
হঠাৎ হাতের কলমটা থেমে গেলো, কলমের কালিটাও শেষ হয়ে গেলো, কাগজগুলো সব নাই হয়ে গেলো | তারপরও মানুষ লিখছে......কারণ লেখা কখনো বন্ধ করা যায়না | লেখকের মৃত্যু হয়, লেখার মৃত্যু হয়না |