মইনুল ইসলাম মিতুল : চলছে জ্যৈষ্ঠের তাপপ্রবাহ, অসহ্য গরমে জনজীবন যখন
হাঁসফাঁস করছে তখন ঘন ঘন লোডশেডিং দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। দেশের বিভিন্ন
এলাকায় চলছে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ। এই বেহাল দশা
থেকে সহসাই মুক্তির আশাও দেখা যাচ্ছে না। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের
চাহিদাও বেড়েছে। আবার জ্বালানি সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বেশ কিছু
বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন এখন বন্ধ। এ অবস্থায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে
পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা এখন নির্ভর করছেন
বৃষ্টির ওপরে। তাপমাত্রা কমে এলে বা এক পশলা বৃষ্টি হলেই বিদ্যুতের চাহিদা ৩ থেকে
৪ হাজার মেগাওয়াট কমে আসবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় এখন লোডশেডিং হচ্ছে
গড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা করে। কোথাও কোথাও ৮ ঘণ্টা। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের দৈনিক
চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু উৎপাদনে ঘাটতি থাকছে ৩ হাজার মেগাওয়াট।
মধ্য রাতে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। বিতরণ
কোম্পানিগুলো বলছে, প্রচণ্ড গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় এবং
উৎপাদন ঘাটতিতে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
বিতরণ কোম্পানি ডেসকো ও ডিপিডিসির তথ্য মতে, রবিবার ডেসকোর চাহিদা ছিল ১
হাজার ৩৮৬ মেগাওয়াট, সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ১৩৬ মেগাওয়াট,
লোডশেডিং করা হয়েছে ২৫০ মেগাওয়াট। অপরদিকে ডিপিডিসির বিতরণ অঞ্চলে
বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২ হাজার মেগাওয়াট, সরবরাহ করা হয়েছে ১
হাজার ৬৭০ মেগাওয়াট, লোডশেডিং করা হয়েছে ৩৩০ মেগাওয়াট।
রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ
(পিজিসিবি) সূত্রে জানা যায়, রবিবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৩০০
মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করা হয়েছে ২ হাজার ৩৯৫
মেগাওয়াট। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, লোডশেডিংয়ের পরিমাণ এর
চেয়ে অনেক বেশি।
এদিকে কয়লা সংকটের কারণে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের
দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনও বন্ধ হয়েছে গতকাল সোমবার। এর ফলে লোডশেডিং আরো কয়েকগুণ
বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এস
এম ওয়াজেদ আলী বলেন,
আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করছি লোডশেডিং কমিয়ে আনার। বেশ কয়েকটি
বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়িয়েছি, যাতে ঘাটতি কমিয়ে আনা
যায়।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা এখন নির্ভর করছেন
বৃষ্টির ওপরে। তবে এক্ষেত্রে সুখবর দিচ্ছে না আবহাওয়া অধিদপ্তরও। আবহাওয়া
অধিদপ্তরের তথ্য মতে,
সহসাই তাপপ্রবাহ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর সোমবার
জানিয়েছে, অস্বস্তিকর এই গরম আরো পাঁচ-ছয় দিন থাকবে।
এদিকে চলমান লোডশেডিংয়ের মধ্যেই দেশের সবচেয়ে বড়
কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধের পর থেকে কয়লার মজুদ শেষ
হওয়ায় পুরোপুরি বন্ধ হতে যাচ্ছে। ডলারের অভাবে বিল বকেয়া পড়ায় কয়েক মাস ধরে কয়লা
কিনতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মে মাস থেকে শুরু হওয়া লোডশেডিং আরো খারাপ
পরিস্থিতির দিকে যাবে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, জুন মাসজুড়েই লোডশেডিংয়ের
জন্য দেশবাসীকে ভুগতে হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা, গ্যাস ও তেলের অভাবসহ
রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এখন ৫০টির বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ
উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট হলেও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি
সংকটের কারণে গড়ে অন্তত ৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট। কিন্তু
গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত গ্যাস স্বল্পতার কারণে উৎপাদন করা হয় ৬ হাজার ৩৯৩
মেগাওয়াট। অন্যদিকে ফার্নেস তেল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার
মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু রবিবার (৪ জুন) উৎপাদন করা হয়েছে ২ হাজার ৬৭ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ। আর কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। কিন্তু একই
দিনে উৎপাদিত হয় ১ হাজার ৯৯২ মেগাওয়াট।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, এই কদিন আমরা গ্যাসচালিত
বিদ্যুৎ দিয়ে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। কিন্তু
এরপরও চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য রয়ে গেছে। অত্যধিক গরমের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা
বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়বহুল হওয়ায় আমরা
কম ব্যবহার করি। পিক আওয়ারে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানো হয়। সাধারণত এই বিদ্যুৎ
কেন্দ্রগুলো রাতে চালানো হয়। ফলে দিনে লোডশেডিং করতে হয়। রাতে সাড়ে ৪ হাজার
মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিনের চেয়ে বেশি লাগে। ফলে তখন লোডশেডিংও বেশি হয়। একদিকে
বৈশ্বিক সংকট, অন্যদিকে পরিবেশও আমাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ
করছে। দুটো মিলিয়ে লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক (জনসংযোগ
পরিদপ্তর) মো. শামীম হাসান বলেন, তাপমাত্রা কমে এলে বা এক পশলা বৃষ্টি হলেই
বিদ্যুতের চাহিদা ৩ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট কমে আসবে। এ ছাড়া আপাতত নাটকীয় কোনো
পরিস্থিতি তৈরি না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। নতুন কোনো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র যে
দুই সপ্তাহের মধ্যে আসবে এমন সম্ভাবনাও নেই। ফলে খুব তাড়াতাড়ি লোডশেডিং নিয়ে
স্বস্তির কোনো খবর নেই।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি
উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, কখন কী ধরনের বিদ্যুতের চাহিদা হয় এ
ব্যাপারে পিডিবি থেকে সরকারকে আগেই জানানো হয়েছিল। আমরা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছি।
আবার আদানির বিদ্যুৎও এর মধ্যে জাতীয় গ্রিডে এসেছে। সব মিলিয়ে চাহিদামতো বিদ্যুৎ
উৎপাদন করার কাঠামোগত কোনো সমস্যা নেই। গত বছরও এ সমস্যা ছিল, চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি সরবরাহ করতে পারিনি। কোনো ধরনের
জ্বালানি সরবরাহ করা যাবে আর কোনটি যাবে না, কোনটিতে খরচ
তুলনামূলক কম হবে এসব বিচার-বিশ্লেষণ করে জ্বালানির চাহিদা বের করা কঠিন ছিল না।
এই পরিকল্পনা আগে থেকে নেওয়া যেত।
তিনি আরো বলেন, খাদ্য সংকট হলে যেমন মানুষ মারা যায়,
একইভাবে জ্বালানি সংকট হলে অর্থনীতি মারা যায়। এ বিষয়টি জ্বালানি
মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়েরও বোঝা উচিত।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো প্রায় দুই
সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল
হামিদ। তিনি বলেছেন, আমি জানি লোডশেডিং বড় হওয়ায় পরিস্থিতিটা
অসহনীয় হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে আমরা চেষ্টা করছি এটা কত দ্রুত সমাধান করা
যায়। সরকারের পক্ষ থেকে এটা সমাধানের চেষ্টা চলছে যে কত দ্রুত অন্তত পায়রায় (পায়রা
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র) কয়লা নিয়ে আসা যায়। ওটা বর্তমানে অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে।
বড়পুকুরিয়ায় অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। আমাদের লিকুইড ফুয়েল যে পাওয়ার প্লান্টগুলো
ছিল সেগুলোও প্রায় অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। এসব কারণে আমাদের লোডশেডিংয়ের মাত্রা
অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে নসরুল হামিদ বলেন, আমরা আশা করব আগামী ১০ থেকে
১৫ দিনের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে আসার। কারণ আমাদের কয়লা, তেল, গ্যাসের জোগান দিতে হচ্ছে, আবার ইন্ডাস্ট্রিতেও গ্যাস দিতে হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি একসঙ্গে এসেছে।
নসরুল হামিদ বলেন, আমরা কিছু জায়গায় কিছুটা লোডশেডিং করছি।
আমাদের কয়লা, গ্যাস ও তেলের শর্টেজ। আমরা ঠিকমতো জোগান দিতে
পারছি না। সে কারণে এ ঝামেলাটা হচ্ছে। আমি মনে করি এটা খুব সাময়িক। এটা নিয়ে এত
হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এরই মধ্যে জোগানের চেষ্টা হয়ে গেছে। চেষ্টা করছি অন্তত দুই
সপ্তাহের মধ্যে আমরা একটা ভালো পরিস্থিতিতে যেতে পারব।